শনিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২১, ১২:০০ পূর্বাহ্ন
আল ফাতাহ মামুন
‘প্রেম’ বলে কয়ে হয় না। প্রেম জন্মায়। প্রেম হয়ে যায়। কোরআন বলেছে, ‘মায়ের প্রতি কোমল ডানা বিছিয়ে দাও’।
এ আয়াতের ব্যাখ্যা করে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘মায়ের সঙ্গে সবচেয়ে উত্তম আচরণ কর।’ উত্তম আচরণই ভালোবাসার প্রকাশ। মুখে ভালোবাসি বললেই ভালোবাসা হয়ে যায় না। ভালোবাসা প্রকাশ পায় কাজে।
তবুও আমরা দেখেছি রাসূল (সা.) কখনোসখনো মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলে ফেলেছেন। বলেছেন, ‘আমি আরবকে ভালোবাসি’, ‘আমি মক্কাকে ভালোবাসি’ এবং বলেছেন, উহুদ পাহাড় আমার ভালোবাসা।
রাসূল (সা.) নিজ দেশকে কত ভালোবাসতেন তার অসংখ্য উদাহরণ হাদিসের গ্রন্থগুলোতে পাওয়া যায়। রাসূল (সা.)-এর দেশপ্রেমের কথা বলতে গেলে অনেকেই হজরতের মক্কা প্রেমের উদাহরণগুলো নিয়ে আসেন।
কিন্তু গভীর মনোযোগের সঙ্গে সিরাত অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, রাসূল (সা.)-এর চূড়ান্ত দেশপ্রেম প্রকাশ পেয়েছে মদিনায়, মক্কায় নয়। মক্কা যদিও রাসূল (সা.)-এর মাতৃভূমি, কিন্তু মদিনাকে আলাদা ভূখণ্ড বা দেশ বলার কোনো সুযোগ নেই। মক্কা-মদিনা দুটিই আরব ভূখণ্ডের আলাদা শহর মাত্র।
তাছাড়া মদিনা রাসূল (সা.)-এর নানার বাড়িও। তিরমিজি শরিফের বর্ণনায় এসেছে, হিজরতের সময় রাসূল (সা.) বারবার মক্কার দিকে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘প্রিয় মক্কা! বসবাসের জন্য তুমি কতই না প্রিয়, কতই না উত্তম। তোমার সন্তানরা যদি আমাকে বের করে না দিত, তাহলে কখনই আমি অন্য শহরে যেতাম না।’
এ একটি বাণী থেকেই বোঝা যায়, রাসূল (সা.) মক্কাকে কী গভীর ভালোবাসতেন। কিন্তু এর অল্প কিছুদিন পরই যখন আবু সুফিয়ান মদিনার পথ ধরে মক্কাবাসীর জন্য যুদ্ধাস্ত্রের বিশাল বহর নিয়ে যাচ্ছিলেন, মদিনার নিরাপত্তার স্বার্থেই রাসূল (সা.) আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলা আক্রমণ করেন।
‘সিরাতে ইনসানিয়াতে’র লেখক মাওলানা নঈম সিদ্দিকি বলেন, ‘মক্কার সব লোক তাদের শেষ সম্বল আবু সুফিয়ানের হাতে দিয়ে বলেছিল, অস্ত্র কিনে আন। মুহাম্মদ এবং মদিনাকে অল্পতেই নিঃশেষ করে দিতে হবে। এ ঘটনা যখন রাসূল (সা.) জানতে পারলেন, তখন শিশু রাষ্ট্র মদিনার সার্বভৌমত্ব রক্ষার তাগিদেই নবীজি (সা.) আবু সুফিয়ানের অস্ত্রবহর আটক করেন।’
নঈম সিদ্দিকী বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের জন্যই তার রাস্তা ব্যবহার করে তার রাষ্ট্র ধ্বংস করার জন্যই অস্ত্রবহর নিয়ে যেতে দেখে নীরব থাকা সম্ভব নয় এবং উচিতও নয়। আবু সুফিয়ানের অস্ত্রবহর আটক করার শেষ পরিণতি দাঁড়ায় বদর যুদ্ধ।’ ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য প্রথম ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এটি। বদরের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। কিন্তু এটি যে রাসূল ও সাহাবিদের জন্য প্রথম মুক্তিযুদ্ধ এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা অনেকেই বিশ্লেষণ করি না।
স্যার সৈয়দ আমীর আলী তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য স্পিরিট অব ইসলামে’ লিখেছেন, ‘রাসূল (সা.)-এর অধিকাংশ যুদ্ধই ছিল মদিনার সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই। মদিনা যেন কোনোভাবেই শত্রুপক্ষের আক্রমণের শিকার না হয় এ ব্যাপারে রাসূল (সা.) সব সময় সজাগ ছিলেন। তিনি সৈনিক সাহাবিদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য বলতেন, ‘এক রাত দেশের সীমান্ত পাহারা দেয়া পৃথিবীর সব সম্পদ অর্জন করার চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি ভালো।’ (বুখারি, কিতাবুল জিহাদ)।
খয়বর যুদ্ধের সময় মদিনার সীমান্ত রক্ষার জন্য রাসূল (সা.) যখন পেরেশান, তখন সালমান ফারসি (রা.) মদিনার চারপাশে পরিখা খনন করে মদিনাকে শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচানোর পরামর্শ দেন। এ অভিনব পরামর্শ শুনে রাসূল (সা.) এতই আনন্দিত হন যে, সঙ্গে সঙ্গে সালমান ফারসির জন্য বিশেষ দোয়া করেন।
মদিনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাসূল (সা.) নিজে মাটি কেটেছেন, মাথায় মাটি বয়েছেন। অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে শেষ বয়সে রাসূল (সা.) কোমরের ব্যথায় পর্যন্ত ভুগেছেন। রাসূলের পুরো জীবনই ছিল দেশপ্রেমের অনন্য উদাহরণ। দুঃখজনক হলেও সত্য! আমরা এখনও আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে নবীজি (সা.)-এর মতো ভালোবাসতে পারিনি।
অথচ রাসূল শিখিয়েছেন, নিজ দেশকে ভালো না বাসলে, দুনিয়া-আখিরাতে মর্যাদাবান হওয়া যায় না। শেষ করছি আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার ড. মাহাথির মুহাম্মদের বাণী দিয়ে- ‘যে জাতির মাঝে দেশপ্রেম নেই, সে জাতি কখনও উন্নত জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।’
লেখক : সাংবাদিক