রবিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২১, ০৬:৫৪ পূর্বাহ্ন
টঙ্গী ইজতেমা ময়দানে ঘটে যাওয়া রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও হতাহতের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করেছেন তাবলিগের মূলধারার সাথীরা। সোমবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী হলে এ সংবাদ সম্মেলন করেন তাবলিগের নিজামুদ্দীন অনুসারীরা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কাকরাইল মসজিদের মুরব্বি মাওলানা আশরাফ আলী। তিনি বলেন, প্রতিক্রিয়াশীল একটি গোষ্ঠী দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাবলিগ জামাতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তাদের হস্তক্ষেপ গোটা জামাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। অরাজনৈতিক এ দ্বীনি মেহনতকে তারা রাজনীতির হাতিয়ার বানিয়েছে। গত দুই মাস ধরে তারাই পেশিশক্তির বলে টঙ্গী ইজতেমা ময়দান দখল করে রেখেছিল।
আশরাফ আলী বলেন, মাদ্রাসার নিরীহ ছাত্রদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তাবলিগের মূলধারার সাথীদের ময়দানে প্রবেশে বাধা দিয়েছে। আগামী ১১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব ইজতেমা সফলের লক্ষ্যে সাধারণ সাথীরা গত ৩০ নভেম্বর ময়দানে গেলে তারা প্রবেশে বাধা দেয়। ইজতেমা ময়দানের প্রতিটি গেটে তালা লাগিয়ে তারা মাদ্রাসার ছাত্রদের দিয়ে পাহারা বসায়।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, প্রশাসনের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে হাজার হাজার সাথী ময়দানের বাইরে তালিমরত ছিল। এমতাবস্থায় ভেতর থেকে ইটপাথরের ঢিল নিক্ষেপ করে সংঘর্ষের সৃষ্টি করে। তাদের এলোপাতাড়ি ইটপাটকেলের আঘাতে অনেক সাথী আহত হয়। এরপরও সাথীরা কোনো আঘাত না করে তাদের নিবৃত্ত করার জন্য হ্যান্ডমাইকে আহ্বান জানায়। ভেতর থেকে মুহুর্মুহু আক্রমণের মুখে একপর্যায়ে সংঘর্ষ বেধে যায়।
আশরাফ আলী বলেন, বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে সাথীরা ভেতরে প্রবেশের পর তাদের আক্রমণ আরও তীব্র হয়। আমাদের সাথীরা তাদের বারবার থামতে আহ্বান জানানোর পরও তাদের নিবৃত্ত করা যায়নি। মাদ্রাসা ছাত্রদের নির্মম আঘাতে তাবলিগের মূলধারার ইসমাইল মণ্ডল (৬২) নামে মুন্সিগঞ্জের এক সাথী নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া প্রায় দুই শতাধিক আহত হয়েছেন।
সংঘটিত ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে বলেন, এ ঘটনার মূল সূত্রপাত বিবেচনা করে দায়ীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া তাবলিগে বহিরাগতশক্তির অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। গত দুই মাস ধরে কারা দখল করে রেখেছে, তা দেশবাসী ভালোভাবেই অবগত রয়েছেন।
এতে বলা হয়, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক, ইসলামী ঐক্যজোটের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মাসউদুল করিম, মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ ও মাওলানা কেফায়েতুল্লাহ আজহারীর নেতৃত্বে কয়েক হাজার মাদ্রাসাছাত্র গত এক মাস ধরে টঙ্গী ময়দান দখল করে রেখেছিল।
গত বিশ্ব ইজতেমার পর থেকে তাবলিগের বহিরাগত এ আলেমরা জেলায় জেলায় নিজামুদ্দীনের অনুসারীদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ করে বলেন, প্রতিটি জেলা ইজতেমায় তারা আমাদের বাধা দিয়েছে। বিগত ৬ মাসে ১ হাজার ৪ টি প্রোগ্রামে তারা সরাসরি বাধা দেয়। গত অক্টোবরে ঢাকা জেলার ইজতেমায় তারা দফায় দফায় বাধা দেয়। ডেমরা,সাভার ও মিরপুরে ইজতেমার নির্ধারিত জায়গায় অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে। শুধুমাত্র দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য আমাদের সাথীগণ সর্বক্ষেত্রে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে।
বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবরোধ করে হেফাজতপন্থীরা দেশবাসীকে চরম দুর্ভোগে ফেলেছে এমন অভিযোগ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিভিন্ন গাড়িতে তল্লাশি করে আমাদের সাথীদের বের করে মারধর করেছে। সামগ্রিক অবস্থার প্রেক্ষিতে আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এসবের পূর্ণ দায়ভার তাদের ওপরই বর্তায়। লাঠিসোঁটা নিয়ে চরদখলের মতো ইজতেমায় পবিত্র ময়দান দখলসহ উসকানিমূলক বক্তৃতা, সড়ক অবরোধসহ যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তারা সৃষ্টি করেছে তাবলিগের ইতিহাসে তা এক কলঙ্কময় অধ্যায়।
টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমার ময়দান দখল করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিকারীদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় এনে এর বিচার বিভাগীয় তদন্তসহ কয়েক দফা দাবি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলন থেকে।
মাওলানা আশরাফ আলী বলেন, টঙ্গীর সংঘর্ষের পর মাওলানা সাদের বিরোধিতাকারীরা গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় সাদের অনুসারীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এতে সারা দেশে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে এবং গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ সঙ্কট নিরসনে তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে সাত দফা দাবি তুলে ধরেন সাদ অনুসারীরা। দাবি প্রসঙ্গে মাওলানা আশরাফ আলী বলেন, তারা (সাদ বিরোধীরা) যদি কোন সমাধানে না আসেন, আমরা কোন বিরোধ চাই না। তারা (সাদ বিরোধী) তাদের মতো কার্যক্রম পরিচালনা করুক, আমরা আমাদের মতো করবো। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কার্যক্রম পরিচালনা করার সুযোগ দেয়া হোক। তারা তাদের পছন্দ মতো সময়ে ইজতেমা করবে, আমরা আমাদের মতো ইজতেমা করবো। আমাদের ইজতেমায় দেশ বিদেশ থেকে মুরব্বিরা আসবেন, সেক্ষেত্রে তারা যেন বাধা না দেন। দু’পক্ষের বিরোধে তাবলীগের মেহনতের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত নয় এমন ব্যক্তি, মাদ্রাসার শিক্ষক ও আলেমকে না জড়ানোর দাবি জানান তারা।
মাওলানা আশরাফ আলী জানান, ওই দিন মাদ্রাসার ছাত্রদের লেলিয়ে দিয়ে নির্মমভাবে হামলা চালানো হয়েছে। আগে থেকে অস্ত্র, বাঁশের লাঠি নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন মাওলানা জুবায়ের অনুসারীরা। তারা আগে থেকেই রক্তের বন্যা বইয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল প্রতিটি ওজাহাতি জোড়ে। তারা সারা বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে।
আশরাফ আলী বলেন, ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে তাবলীগের কার্যক্রম পরিচালনার পরিপত্র সময়োপযোগী ছিল। কিন্তু ২৪ সেপ্টেম্বর তা স্থগিত করা হয়৷এর ফলে গত ২ বছরের চলমান সমস্যা মাথাচাড়া দেয়। সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপন বলা হয়েছিল, যে যার মতো কাজ চালাবে, এক পক্ষ অন্য পক্ষের কাজে বাধা দেবে না। কিন্তু সরকার সেই প্রজ্ঞাপন বাতিল করার পর থেকে তারা (সাদ বিরোধীরা) মারমুখী হয়ে উঠেছে।
সংর্ঘষ তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নিতে পারে এমন আশঙ্কা করে মাওলানা আশরাফ আলী বলেন, আমাদের সাথীরা সকাল থেকে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। ২৫ নভেম্বর আমরা গাজীপুরের ডিসি ও পুলিশ কমিশনারকে চিঠি দিয়ে ৩০ তারিখ জোড় করার ব্যাপারে চিঠি দিয়েছিলাম। সব নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তারা (সা’দবিরোধীরা) মাঠ প্রস্তুত ও ৭ ডিসেম্বের জোড়ের ঘোষণা দিতে থাকে।
আশরাফ আলী আরও বলেন, আমাদের দাবি ছিল, আমরা যেন মাঠ প্রস্তুত করার ব্যাপারে সমান সুযোগ পাই। তাই আমাদের সাথীরা গত শনিবার শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে মাঠের চারপাশে বসে ছিল। প্রশাসনের সহযোগিতা দাবি করছিলাম যাতে তারা (সাদ বিরোধীরা) শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের মাঠে ঢুকতে দেওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা করে। আমাদের কর্মসূচি ছিল শান্তিপূর্ণ এবং অহিংস। আমরা টঙ্গীর ইজতেমা মাঠের আশপাশের কোনো রাস্তা অবরোধ করিনি, বরং যানবাহন যেন স্বাভাবিক গতিতে চলাচল করতে পারে সে জন্য আলাদা জামাত গঠন করা হয়েছিল।
তাবলিগের এই মুরুব্বি বলেন, আমাদের দাবি প্রশাসনকে জানালে তারা মাঠ খালি করে দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। বেলা ১১টা পর্যন্ত প্রশাসনের সবাইকে অনুরোধ করছিলাম আমাদের যেসব জামাত আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে যাবে তাদের যেন অন্ততপক্ষে মাঠে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়। কিন্তু তারা পুলিশকে লক্ষ্য করেও ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। একপর্যায়ে আমাদের সাথীরা অনেকেই আহত হলে ছাত্রদের ইটপাটকেল বন্ধ করতে ভেতরে ঢুকে পড়ে।
সংবাদ সম্মেলনে ৭ দফা দাবি তুলে ধরে মাওলানা আশরাফ আলী বলেন, তারা যদি কোনো সমাধানে না আসেন, আমরা কোনো বিরোধ চাই না। তারা তাদের মতো কার্যক্রম পরিচালনা করুক, আমরা আমাদের মতো করবো। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কার্যক্রম পরিচালনা করার সুযোগ দেওয়া হোক, যেটি সরকারের পরিপত্রে ঘোষণা করা হয়েছিলো। তারা তাদের পছন্দ মতো সময়ে ইজতেমার করবে, আমরা আমাদের মতো ইজতেমা করবো। আমাদের ইজতেমায় দেশ-বিদেশ থেকে মুরব্বিরা আসবেন, সেক্ষেত্রে তারা যেন বাধা না দেন।
আশরাফ আলী অভিযোগ করেন, বহুবার তাবলিগ জামাতের সমস্যা সমাধানের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলা হয়, প্রশাসনে চিঠি পাঠানো হয় ১০০ বারের বেশি। কিন্তু কেউ আমলে নেয়নি। সরকারের কোনো এক পক্ষের অবহেলার কারণে টঙ্গীর সংঘর্ষে একজন নিহত হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে গেছে। এই সংঘর্ষে তৃতীয় পক্ষের অবস্থানের কথাও জানান মাওলানা সাদের সমর্থকরা।
দাবিগুলো হলো, নিহত ও আহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ ও তাদের পরিবারের দায়দায়িত্ব নেয়া, টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে দখলদার মুক্ত রাখা, দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল ও সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য ওয়াজাতী জোড়ের নামে সারা দেশে উসকানিমূলক সভা এবং প্রোপাগান্ডা বন্ধ করা, তাবলিগ জামাতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বহিরাগতদের অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করা ও আগামী ১১,১২,১৩ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব ইজতেমা যথাসময়ে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সহায়তা করা।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন কাকরাইলের মুরব্বি মাওলানা মুনির বিন ইউসুফ, মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ, মাওলানা আবদুল্লাহ , মাওলানা সাইফুল্লাহ প্রমুখ।