শনিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২১, ১২:১৭ অপরাহ্ন
তাবলিগ নিয়ে নাগরিক ভাবনা | সৈয়দ মবনু
হাজী সৈয়দ আব্দুস সালাম রাজা মিয়া, থাকেন ইংল্যান্ডের সান্ডারল্যান্ড শহরে। দেশের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার সৈয়দপুর গ্রামে। তিনি সৈয়দপুর গ্রামের প্রবীণ শিক্ষিতদের অন্যতম একজন। বয়সে তিনি আমার বাপ-চাচাদের বয়সি। তাবলিগের মুরুব্বী ইঞ্জিনিয়ার মুকিত সাহেব তাঁর ছাত্রজীবনের বন্ধু। প্রকৃত অর্থে হাজী সৈয়দ আব্দুস সালাম রাজা মিয়া তাঁর পরিচিত ছোট-বড় সকলের বন্ধু এবং আপনজন। তিনি নিয়মিত প্রতি বছর তাবলিগে চিল্লা দেন এবং স্থানীয়ভাবে সময় লাগান।
সেদিন টেলিফোনে দুঃখ করে বললেন, এ বছর এই মারামারির কারণে চিল্লায় যেতে পারেননি। তিনি কিছুটা ভাবিত, কোনদিকে যাবেন। দেবন্দি আলেমদের সাথে যেমন তাঁর গভীর সম্পর্ক, তেমনি সম্পর্ক রয়েছে তাবলিগের আলেমদের সাথেও। তিনি যেমন দেওবন্দ গিয়েছেন, তেমনি গিয়েছেন নিজামুদ্দিনেও। বৃটেনে অবস্থানরত তাবলিগি এবং নন-তাবলিগি আলেমদের সাথে তাঁর রয়েছে অনেক গভীর সম্পর্ক। তিনি কাকে রাখেন, কাকে ছাড়েন।
আলেমরা যে অভিযোগ করতেছেন সাদ সাহেব সম্পর্কে তা তো তিনি নিজে পাচ্ছেন না, তবে বিশ্বাস করবেনটা কীভাবে, আবার একথাও ভাবতে পারছেন না দেওবন্দের আলেমরা মিথ্যা বলতেছেন। তিনি এক মহাসংকটে আছেন। তবে তিনি স্বীকার করলেন, বাংলাদেশের অজাহাতি আলেমরা এতায়াতিদের বিরুদ্ধে বেশি কট্টর অবস্থানে, যা আর কোথাও নেই। তিনি টেলিফোনে হাসতে হাসতে বললেন, তোমার ফেসবুকে লেখা পড়ি। জানতে চাইলাম, ভাইসাহেব; আমি কি ভুল কিছু বলেছি। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, তুমি অনেক কথা ভেতর থেকে বের করে নিয়ে আসছো, ভেতরের অনেক খবর রাখছো।
আমি বললাম, দেখুন, আমিও আল্লাহকে ভয় করি, আমি আল্লাহর কাছ থেকে বাঁচতে চাই। আমি ‘জুমলায়ে খবরিয়ার’ বিধান জানি। খবর সত্য হতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে। নিজে তাহকিক না করলে খবরের উপর বিশ্বাস করা যায় না। আমি যে বিষয়গুলো লিখছি তা নিজস্বসূত্রে তাহকিক করে লিখছি। আমি আল্লাহর কাছ থেকে বাঁচতে চাই। বাংলাদেশে যে আলেমরা মাওলানা সাদ সাহেবের বিরুদ্ধে কথা বলছেন তারা আমার আপনজন। আমি নিজে অনেক আগে ছোটবেলা তাবলিগে চিল্লা দিলেও এখন আর তেমন যোগাযোগ নেই।
সাদ সাহেবকে আমি চিনতাম না। তাকে যখন চারদিক থেকে গালাগালি শুরু হলো তখন আমি তথ্য সংগ্রহ শুরু করি। আমার সংগ্রকৃত তথ্যে যা বেরিয়ে আসে তা আমি বলি। আর কেউ আমার কথা বিশ্বাস না করলেও আমি তো আমার সংগ্রকৃত তথ্যে অটল থাকতে হয় আল্লাহ, কিয়ামত, হাশর, বিচার ইত্যাদি সামনে রেখে।
হাজী সৈয়দ আব্দুস সালাম রাজা মিয়া বললেন, আলেমরা যা বলছেন সেগুলোকে আমরা মিথ্যা বলবো কোন সাহসে, যদিও তোমার মতো আমারও কিছু তাহকিক রয়েছে। আলেমরা যে অভিযোগ করছেন, সাদ সাহেব বলেছেন-সাদ সাহেব বলেছেন পৃথিবীতে তিনটি বরকতময় জায়গা, ১.মক্কা, ২. মদিনা, ৩. নিজামুদ্দিন। এই তিন মসজিদে নামাজ পড়লে হাজার হাজার রাকাত নামাজের সোয়াব মিলে। তিনি মক্কা মদিনার সাথে নিজামুদ্দিনকে মিলিয়ে বরকতময় বললেন, তা কি সঠিক হলো?
আমি বললাম, ভাইসাহেব, কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি তথ্য নিয়ে জেনেছি, মাওলানা সাদ সাহেব বলেছেন, পৃথিবীর মধ্যে তিন স্থানে তাবলিগের গুরুত্বপূর্ণ মাশওয়ারা (পরামর্শ) হয়, ১. হজ্বের সময় মক্কায়, ২. বিশ্ব ইজতেমার সময় ঢাকায়, ৩. নিয়মিত নিজামুদ্দিনে। তা ছাড়া বিভিন্ন ওয়াজে আমি আলেমদের মুখে শোনেছি বড় জামায়াতে নামাজ পড়লে সোয়াব বেশি। বিশ্বা ইজতেমায় জামায়াত বড় হয়, সেই হিসাবে যদি বলেন তা কি ভুল?
আমি বললাম, ভাইসাহেব, মিথ্যার উপর আমরা কতটুকু গিয়েছি চিন্তা করুন, কেউ কেউ প্রচার করছে, মাওলানা সাদ সাহেব নাকি কালেমাকে পরিবর্তন করে তাবলিগের সাথীদেরকে শিখাচ্ছেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাললাহু সাদ হাফিজাল্লাহ’, আপনি কি মানে করেন তা সত্য। রাজা মিয়া সাহেব, বলে উঠলেন, নাউযুবিল্লাহ। অসম্ভব, অবশ্যই একথা মিথ্যা। তবে আলেমদের একটা কথা হলো, সাদ সাহেব বিভিন্ন বিষয়ে ফতোয়া দেন কেন, ফতোয়া দেওয়া তো আলেমদের কাজ? আমি বললাম, তিনি ও তো আলেম, মুফতি, শায়খুলহাদিস। তিনি বললেন, তিনি তো তাবলিগের দায়িত্বশীল, তিনি ফতোয়া দিলে সমস্যা তো হবেই। যেমন তিনি বলেছেন, মাদরাসায় পড়িয়ে এবং মসজিদে ইমামতি করে টাকা নেওয়া জায়েজ নয়। আমি বললাম, ফতোয়ার মৌলিক কিতাব কিংবা সাহাবায়ে কিরামের আমলে এই বিষয়ে কি বলা হয়েছে, একটু পর্যবেক্ষণ করে বলুন। পরবর্তি ফকিহ (ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞ) গণ তা এজন্য জায়েজ বলেছেন, নতুবা মসজিদে ইমাম এবং মাদরাসায় শিক্ষক পাওয়া যাবে না।
মাওলানা সাদ পরবর্তিদের কথাকে শ্রদ্ধা রেখে প্রথম সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তার এই কথাগুলো ছিলো নিজামুদ্দিন কেন্দ্রিক। নিজামুদ্দিনকে তখন একদল গোজরাটি ইসলাম ব্যবসার কেন্দ্র করে নিয়েছিলো, যেভাবে বর্তমান বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ইত্যাদি ইসলামী সংগঠনগুলো তাদের সংগঠনকে ব্যবসার কর্পোরেট সংস্থার মতো করে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে জায়গার ব্যবসা, প্লাট ব্যবসা, নেটওয়ার্কিং ব্যবসাকে জমজমাট করে ইসলামের মূল স্রোত থেকে দূরে সরেগেছেন দ্বীনি স্বার্থে। মাওলানা সাদ সাহেব এসে এগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করলে তাবলিগের সুবিধাবাদি গ্রুপ বিদ্রোহ করলো।
সাদ সাহেব খুব দৃঢ়ভাবে নিজামুদ্দিনে ওদেরকে দমন করে ওদেরকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিলেন। যুদ্ধটা এখানেই শুরু হয়। পরে আরও বিভিন্ন বিষয় এখানে সংযুক্ত হয়। সেই বিদ্রোহকে দমনকালে সাদ সাহেব ইসলামের মৌলিক হালাল-হারাম বিষয়ক যে বয়ানগুলো দিয়েছেন সেগুলোকে রেকর্ড করে খন্ডাংশগুলো দেওবন্দ-এ পৌঁছালে এখানের কিছু আলেম বিভ্রান্ত হন। আমরা এখানে ইতিহাস থেকে হযরত আলী এবং হযরত মুয়াবিয়া (রা.), হযরত ইমাম হোসাইন এবং ইয়াজিদের মধ্যকার যুদ্ধের প্রেক্ষাপটের সাথে মাওলানা সাদ-এর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগকে বিবেচনা করলে অনেককিছুই অনুভব করতে পারবো। কুফাবাসি বিভ্রান্ত হয়েছিলো কীভাবে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর সময় তা আমরা গভীরভাবে পাঠ করলে বুঝতে পারবো আমাদের আলেমরা কেন সাদ সাহেবের উপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আমাদের ইসলামের ইতিহাস বেশি করে পড়া উচিৎ।