বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী ২০২১, ০২:০৫ অপরাহ্ন
মাওলানা সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ, দিল্লী থেকে, তাবলীগ নিউজ বিডিডটকম | তাবলীগের বিশ্ব আমীর হযরতজী মাওলানা সাদ কান্ধলভীর আলিসান রাজকীয় বাড়ির খবর শুনেছিলাম অনেক আগেই। যে বাড়িতে ৫০জন গার্ড, তার মাঝে ৩০জন ইহুদী থাকে। রাজমহলের ভিতর সুইমিং পুল। চিড়িয়াখানা। মুক্তোর ঘাটলা। মারবেল পাথরের মোজাইক। বাগানে হরিন আর ময়ূর পালনের বয়ান জমহুরদের কল্যানে অনেক অজাহাতি বয়ানে শুনার তাওফিক দান করেছিলেন। আর কত আলেম বন্ধু সরাসরি বলেছেন। তাদের কত লেখায় তাঁর এই রাজকীয় বাড়ির গল্প শুনেছি।
দামী কোটি টাকার গাড়ির কাহিনীও বলতে ও লিখতে কসুর করেন নি আমাদের দরদী ওজাহাতি আলেমরা। আজকের দুনিয়ায় এমন গুনগ্রাহী বিরল। এসব শুনে শুনে ভাবতাম, একজন বিশ্ব আমীরের হতেই পারে এমন জৌলুস চকচকে দামী বাড়ি। সারা দুনিয়ায় ঘুরার জন্য নিজেস্ব হ্যালিপেড আর প্লেন থাকাওতো স্বাভাবিক বিষয়।
এরকম কোটি টাকার দামী গাড়ি, আর আলিশান বাড়িতো দেশ বিদেশে আজ আমাদের এলাকার ছোটখাট পীরদেরও আছে। আর তিনি তো শায়খুল আরব ওয়াল আজম, সারা দুনিয়ার কোটি কোটি ধনকুবদের পীর। সাদাকালো, সব দেশ আর সব মাযহাবের লোক যার মুরীদ। এতবড় পীর দুনিয়াতে এই জামানায় আর কে আছেন?
পৃথিবীর সর্ববৃহত ধর্মীয় সংঘের তিনি আমীর। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে, এমনকি প্রতিটি দ্বীপ ও জেলাতে যার কেন্দ্র বা মারকাজ আছে। এমন একজন বিশ্ববরেণ্য মনীষীর ইউরোপ, আমেরিকা, সিঙ্গাপুর আর জার্মান কিংবা মালয়েশিয়াতে তার একাধিক রাজকীয় বাড়ি থাকাটি স্বাভাবিক ছিল।
যার ঘরের দরজায় (নিজামুদ্দিন মারকাজ) দিনের পর দিন আরবের রাজ পরিবারের লোকজন থেকে শুরু করে ধনাঢ্য শায়েখরা পরে থাকেন। ইউরোপ আমেরিকা আর প্রাচ্য পাশ্চাত্যের ধনকুবের মুসলিমরাতো দ্বীন শিখতে তার পিছু ছুঠেন বছরের পর বছর। তার রাজমহল, আর সাহী বালাখানা থাকাটি নিতান্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। এসবতো হলে, তা হত তাঁর, কেবল দুনিয়ার নেয়ামতরের কদরদানী বা শুকরিয়া আদায় মাত্র।
মাওলানা সাদ কান্ধলভীর দাদা পরদাদারা ছিলেন জমিদার। জমিদার নন্দিনী তার নানী দিল্লীতে কেবল ২২একর জায়গা তার নামে লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন। সোনার চামচ মূখে দিয়েইতো তার জন্ম। কোন ফকিরনীর ঘরে বেড়ে ওঠা কোন অভাগা বা গোবর গর্তের পদ্ম ফুল নন তিনি। যে, তার খান্দানে দুজন আলেম কিংবা দুজন জমিদার নেই। তিনিতো সত্যিকারেরই শাহজাদা। যার ফলে শৈশবে তার পড়ালেখাই শুরু হয় মসজিদে নববীতে রওজাতুম মিন রিয়াজিল জান্নাতে বসে।
মাওলানা সাদ কান্ধলভী যে মাপের ব্যাক্তিত্ব তার রাজমহলের মতো বাড়ি থাকাটি কি অস্বাভাবিক কিছু? মাহফিলে মাহফিলে ছোটলোকের মতো আশ্চর্য হয়ে তার রাজমহলের গল্প বলার কি আছে? তবুও বাংলাদেশে তার এই রাজমহলের গল্প এতো শুনেছি, ফলে দেখার লোভ আর সামলাতে পারলাম না। তাই গতকাল ভারতের কান্ধালায় সেই রাজমহলটি দেখতে গিয়েছিলাম।
মুহাররিখুল হিন্দ মাওলানা রাশেদ হাসান কান্ধালভীকে জিজ্ঞাসা করলাম, নিজামুদ্দিন মারকাজের হুজরাখানা ছাড়া হযরতজীর আর কোথায় কোথায় বাড়ি আছে। কারণ উনার কথার চেযে, আর হযরতজী সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে এর চেয়ে গ্রহনযোগ্য ব্যক্তি দ্বীতিয় আরেকজন নেই। তিনি বললেন এটিই তার বাড়ি। এই যে ভেঙে পরা ঘরটি এটি তার পৈতিক বাড়ি। আর কান্ধালা আম বাগানের কাছে এখন বাড়ি করেছেন। মাঝে মধ্যে এখানে কিতাব মুতআালার (অধ্যায়ন) জন্য এলে সে বাড়িতে থাকেন। এছাড়াতো উনার কোন বাড়ি নেই।
হযরত রাশেদ কান্ধালভী দা.বা এর খাছ খাদেম বাংলাদেশের রংপুরের মাওলানা মাহফুজ ভাইকে রাহবার বানিয়ে ছুটলাম সাদ সাহেবের রাজমহল(!) দেখতে। মাহফুজ ভাই দীর্ঘদিন ধরে কান্ধালায় আছেন। সবাই তাকে চিনে। লাইব্রেরীতে পড়ে থাকেন বই পাগল এই মানুষটি। কান্ধালা পরিবারের নাড়ী নক্ষত্র তার জানা।
একটি মাটির ধুলা উরো রাস্তায় আমরা ছুটলাম। মনে মনে ভাবলাম রাজমহলের রাস্তাটির এতো করুন দশা কেন? ভাবতে ভাবতে অনেক আম বাগান পেরিয়ে মাহফুজ নিয়ে গেলেন সাধারণ একটি লোহার গেইটের সামনে। মাহফুজ ভাই বললেন, এই বাগানের আম নিজামুদ্দিনে খায় নি এমন কোন দেশের মানুষ মিলবে না।
আমের জন্য কান্ধালা সারা দুনিয়া বিখ্যাত। পুরো কান্ধালায় মাইলের পর মাইল কেবল আম বাগান। কোন বাগান বাড়িতেও হযরতজীর বাড়ি নয়। এমন একটি সাদামাটা আম বাগান এড়িয়াতে তার সাদামাটা বাড়িটি। যা নিয়ে আষাঢ়ের গল্প সাঝিয়েছেম আমাদের কথিত অপরিনামদর্শী জমহুর আলেমরা। আমাদের অনেক আকাবিরদের লেখায় কান্ধালার আমের কথা আছে। আম পাকা মৌসুমে কান্ধালায় তারা দাওয়াত পেতেন, কখনো কান্ধালার আম তাদের মাদরাসা ও খানকাতে চলে আসত।
মাহফুজ ভাই বললেন, আনোয়ার ভাই এটিই হযরতজীর বাড়ি। গোটা ভারতে “হযরতজী বাড়ি” একনামে সমস্ত উলামায়ে কেরাম চিনেন। মাঝে মধ্য এখানে দেশের বড়বড় উলামারাও আসেন। সাইয়্যিদ আলী মিয়া নদভী লেখালখি করার জন্য মাঝেমধ্যে এই নিরিবিলি পরিবেশে এসে থাকতেন।
আমি বললাম হযরতজি রাজমহল কোথায়? মাহফুজ ভাই অবাক হলেন। বললাম আরো ভেতরে কি রাজমহল আর ৫০গার্ডরা থাকে? মাহফুজ ভাই চোখ কপালে তুললেন! বললাম বাংলার ওজাহাতি বাজারি বক্তা আর নেটের মিথ্যুক মৌলভীদের রাজপ্রসাদের রূপকথার গল্পের কথা। সব শুনে মাথায় হাত দিলেন। ইস্তাগফার পড়তে পড়তে ওজাহাতিদের জন্য হেদায়তের দোয়া করলেন।
যা দেখলাম হযরতজীর রাজমহলে…
চারদিকে কেবল আম গাছ আর আম গাছ। আম বাগানের চারদিকে লাল ইটের পুরানো দেয়াল। উপরে আস্তর নেই। অনেক জায়গা ভেঙ্গে পড়ে আছে। দেখেই বুঝা যায় বাড়ির মালিকের অবহেলা আর সীমাহিন দণ্যতার শিকার এই বাড়িটি।একটু রং বা সিমেন্ট লাগানোর সময় নেই তাদের।
বাড়িতে দুজন খাদেম থাকেন। সারা দিন এরা কুরআন তিলাওয়াত করেন। দুজনই স্থানীয় কান্ধালার বাসিন্দা। খুবই বুজর্গ মানুষ উভয়ই। বাড়ির ভেতরে প্রবশের পর জীর্ণশীণ একটি ছোট্ট বাংলা।
আরেকটু ভিতরক একটি টিনসেট ঘর। একপাশে নামাজের মসজিদ। পেছনে একতলা একটি ঘর ৬/৭টি রুম। উপরে ছাদ। ছাদের উপর চারপাশ খোলা টিনশেড। এই হল হাকীকী সাদ সাহেবের রাজমহলের গল্প। মাহফুজ ভাই বললেন, হযরতজী তো দুনিয়া নিয়ে চিন্তারই সময় নেই। আর বাড়ি ঘর বানানোর সময় কোথায় তাঁর।
আর মায়া হরীণ ও ময়ুরের কোন হদীসতো পাইনি সারা বাড়ি ঘুরে। সুইমিং পুল হয়তো মাটির নিচে। যা স্বপ্নে হররোজ আমাদের জমহুররা দেখতে পান বাংলাদেশে বসে।