রবিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২১, ০৭:১৯ পূর্বাহ্ন
মাওলানা মিরাজ রহমান
সাংবাদিক ও লেখক
গোটা ভারত উপমহাদেশে ‘হজরতজি’ সম্মোদনে পরিচিত ছিলেন তিনি। একনামে ‘হজরতজি’ বললেই মাওলানা এনামুল হাসানকে বুঝতো না এমন মানুষ যেমন আগে ছিল না এখনও নেই বললেই চলে। বিশ্বব্যাপি তাবলিগ জামাতের বৃহৎ পরিসরের এই ব্যাপির নেপথ্যে যে কজন আল্লাহওয়ালা ব্যক্তির জীবন, সময় ও সম্পদ ব্যয় হয়েছে হজরতজি মাওলানা এনামুল হাসান তাঁদের অন্যতম। গোটা জীবনকে ইলমে অহির খেদমতের পাশাপাশি দ্বীনি দাওয়াতের জন্য উৎসর্গ করেদিয়েছিলেন তিনি।
১৯১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ভারতের উত্তর প্রদেশের কান্ধালা নামক স্থানে জন্ম গ্রহণ করেন মাওলানা এনামুল হাসান। পিতা ছিলেন দেশবিখ্যাত আলিম। জেষ্ঠ বুযূর্গ হিসেবেও বেশ পরিচিতি ছিল তাঁর। বাবা মাওলানা ইকরামুল হাসানের তত্ত্বাবধানে ইলমে অহির প্রথম সবক গ্রহণ করেন এনামুল। সুষম একটি দ্বীনি পরিবার ছিল তাঁর জীবনের প্রথম পাঠশালা। এরপর মক্তবে ভর্তি হয়ে আরবি কায়দা, আমপারা, কোরান মাজিদ দেখে তেলাওয়াত করার যোগ্যতা অর্জন করেন। এরপর তৎকালীন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব হাফেজ মাংতুর কাছে পবিত্র কুরআনের হিফজ সমাপ্ত করেন। খুব অল্প সময়ের মাঝে গোটা কোরান হিফজ করেছিলেন তিনি। হিফজ সমাপ্ত করার পর মামা মৌলভি হাকিম আব্দুল হামিদ বড়লভির কাছে উর্দূ ও ফার্সি ভাষাসহ হস্তাক্ষর সুন্দর করার বিদ্যা অর্জন করেন। খুব ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন অলিআল্লাহদের সংস্পর্শে থাকার অপার সুযোগ লাভ করেছিলেন মাওলানা এনামুল হাসান।
আনুমানিক নয় কিংবা দশ বছর বয়সে তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মুরুব্বি মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর তত্ত্বাবধানে নিজামুদ্দিন চলে আসেন এবং মাওলানা ইলিয়াস ও মাওলানা এহতেশামুল হাসানের কাছে আরবি ভাষা-সাহিত্যসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর পাণ্ডিত্ব্য অর্জন করেন। প্রাথমিক পর্যায়ের কিতাবদি অধ্যয়ন করার সময়ই শিক্ষক-মুরুব্বি মাওলানা ইলিয়াসের নজর কাড়েন এনামুল। বালক ছেলের মেধা ও মনোযোগীতা দেখে আরো বেশি থেকে বেশি অধ্যয়ন উপযোগী পরিবেশে রাখার চেষ্ঠা করেন মাওলানা ইলিয়াস। উচ্চশিক্ষা অর্জনের পিপাসা নিয়ে মাওলানা ইলিয়াসের পরামর্শ মোতাবিক ১৯৩৪ সালে সাহরানপুর মাজাহিরুল উলূম মাদরাসায় ভর্তি হন। এই মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার সুবাদে মাওলানা সিদ্দিক আহমদ কাশ্মিরি রহ. সহ দেশবরেণ্য বিভিন্ন আলিমদের কাছ থেকে ইলম অর্জন করার সুযোগ লাভ করেন মাওলানা এনামুল হাসান। আরবি ব্যকরণ, ইলমে ফিকাহ ও দর্শন বিষয়ের ওপর বিশেষ পণ্ডিত্ব ছিল তাঁর। ভুবনবিখ্যাত শাইখুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া কান্দলুভির রহ. কাছে হাদিসের পাঠ গ্রহণ করার মাধমে ‘দাওয়ায়ে হাদিস’ জামাত সমাপ্ত করেন এবং শেষ পরীক্ষায় সবার মাঝে ভালো ফলাফল অর্জন করে পাশ করেন।
মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর অবদানে কানায় কানায় পরিপূর্ণ ছিল তাঁর জীবন। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি বিষয়ে মাওলানা ইলিয়াসের পরামর্শই ছিল মাওলানা এনামুল হাসানের প্রধান পাথেয়। কেবল দ্বীনি দাওয়াত বা পড়াশুনার ক্ষেত্রে নয়, আধ্যাত্মিক সাধনার জগতেও মাওলানা ইলিয়াস ছিল তাঁর ওস্তাদ-পীর। ছাত্রজীবনের কোনো এক সময় আধ্যাত্মিক সাধনার প্রতি আগ্রহী হয়ে মাওলানা ইলিয়াসের কাছে বায়আত গ্রহণ করেছিলেন এবং ধারাবাহিক সাধনার মাধ্যমে সুফিজগতের বিভিন্ন স্তর পার করতে সক্ষম হয়েছিলেন মাওলানা এনামুল হাসান। ফারেগ হওয়ার পরপরই তাবলিগ জামাতের সময় ব্যয় করা শুরু করেছিলেন তিনি। মাওলানা ইলিয়াসের পরামর্শ মতো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে বা স্থানে জামাত নিয়ে সফরে যেতেন। ঠিক এভাবে, একজন মুরুব্বির তত্ত্বাবধানে মাওলানা এনামুল হাসানের দাওয়াতি জীবনের সূচনা হয়েছিল।
নিজামুদ্দিনের কাশিফুল উলূম মাদরাসায় শিক্ষক থাকাকালীন সময়ও দাওয়াতি আমল থেকে কোনোভাবে দূরে ছিলেন না তিনি। এছাড়া এলাকার সব দাওয়াতি কাজের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত থাকতেন মাওলানা এনামুল হাসান। ১৯৬৫ সালে বিশ্বতাবলিগ জামাতের আমির মাওলানা ইউসুফ কান্দলুভির রহ. ইনতিকালের পর শাইখুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া রহ. তাঁকে (মাওলানা এনামুল হাসান) বিশ্বতাবলিগ জামাতের আমির হিসেবে মনোনীত করেন। একজন নওজোয়ান আলিমের কাঁধে এমন বিশাল দায়িত্বভার ন্যস্ত করার ব্যাপারে প্রাথমিক পর্যায়ে কেউ কেউ একমত না থাকলেও মাওলানা এনামুল হাসানের দক্ষতা ও খোদাপ্রীতির একনিষ্ঠতায় তাদের জয় করেছিল পরবর্তীতে। তাবলিগ জামাতের এ দায়িত্ব গ্রহণ করার পর আরো অধিক পরিমাণে উৎসর্গী হয়ে যান মাওলানা এনামুল হাসান। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা একটাই কেবল ফিকির তাঁর- দ্বীনের এই মেহনতের আরো বেশি বিস্তার কীভাবে ঘটানো যায়? নবিওয়ালা এ কাজের সঙ্গে আরো বেশি উম্মতকে কীভাবে জোড়ানো যায়? নবিওয়ালা এ কাজকে বিশ্বপরিমণ্ডলে পৌঁছে দেওয়ার ফিকিরে সর্বদা চিন্তিত থাকতেন তিনি।
নবিওয়ালা এ কাজকে বিশ্বপরিমণ্ডলে পৌঁছে দেওয়ার ফিকিরে সর্বদা চিন্তিত থাকতেন তিনি। সময় পেলেই বলতেন, ‘পৃথিবীর একটি মানুষের কাছেও যদি এ কাজের দাওয়াত পৌঁছানো বাকি থাকে, আমি এনামুল কাল কেয়ামতের দিন আল্লাহ মহানের কাছে কি জবাব দেবো?’ দ্বীনের পথের একনিষ্ঠ এ দায়ি জীবনের সিংহভাগ সময় দ্বীনের দাওয়াতি কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দ্বীনের দাওয়াতি আয়োজনই ছিল তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ আয়োজন। আল্লাহর পথের উৎসর্গী এই মানুষটিও আর রইলেন না। সবার মতো করে তিনিও একদিন চলে গেলেন। প্রিয়তম প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে বিদায় নিলেন এই ধরা থেকে। ১৯৯৫ সালের ১০ জুন প্রিয়তম প্রভুর দরবারের ফেরেশেতারা এসে মাহবুরের ‘দিদারে’ নিয়ে গেলেন এবং স্বহাস্য মনে চলে গেলেন মাওলানা এনামুল হাসান।