শনিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২১, ০৫:৫৮ পূর্বাহ্ন
সিনিয়র ষ্টাফ রিপোর্টার |তাবলীগ নিউজ বিডিডটকম | বিশ্বব্যাপি পরিচালিত মুসলিমদের অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংঘ তাবলিগ জামাত পরিচালনার জন্য ২৪ সদস্যের পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের অভিভাবক পরিষদের চেয়ারম্যান কুমিল্লার মাওলানা আশরাফ আলীকে এই পরিচালনা কমিটির আহবায়ক করা হয়েছে।
বৈঠক সূত্রে জানা যায় যে, গত ১০ ডিসেম্বর হাটহাজারী মাদরাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকে এই কমিটি গঠন করা হয়। গতকাল বুধবার সকালে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে অবস্থিত বেফাক অফিসে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আল্লামা আশরাফ আলীর সভাপতিত্বে বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন মাওলানা আবদুল কুদ্দুস, মাওলানা ওমর ফারুক (প্রাক্তন শুরা, কাকরাইল), মাওলানা মাহফুজুল হক, মাওলানা যুবায়ের আহমদ চৌধুরী, মাওলানা কেফায়েতুল্লাহ আযহারী, মাওলানা আনিসুর রহমান, মাওলানা মনিরুজ্জামান, মাওলানা লোকমান মাজহারী প্রমুখ।
বৈঠক সূত্রগুলো জানায়, তাবলিগ জামাত পরিচালনার জন্য গঠিত কমিটির ২৪ সদস্যরা হলেন, আহববায়ক মাওলানা আশরাফ আলী, সদস্যরা হলেন দাওয়াতুল হকের আমীর মাওলানা মাহমুদুল হাসান, হাইয়াতুল উলিয়ার অন্যতম নিতিনির্ধারক ফরিদাবাদের মাওলানা আবদুল কুদ্দুস, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক, জমিয়ত নেতা মাওলানা বাহাউদ্দিন যাকারিয়া, ড.কামালের গণফোরাম থেকে নমিনেশন উত্তোলনকারী মাওলানা আবদুল হামিদ (মধুপুরের পীর) মাওলানা কেফায়াতুল্লাহ আযহারী, মুফতি মাসউদুল করীম প্রমুখ।
আর ৭ জনকে রাখা হয়েছে কাকরাইলের বিদ্রোহী মুরুব্বী থেকে। তবে বৈঠকে উপস্থিত পাকিস্তানপন্থী শুরার বিদ্রোহী মুরুব্বী মাওলানা উমর ফারুক জানান, তাদের ৭ জনের নাম এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আর বাকি নয় জন হাইআতুল উলয়ার অংশিদার ৫ বোর্ড থেকে নেয়া হতে পারে। বৈঠকসূত্র ও কয়েকটি ইসলামপন্থী অনলাইন নিউজ পোর্টাল এমন সংবাদ প্রকাশ করেছে। তবে আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের নেতৃত্বাধীন বেফাকুল মাদারিসিদ দ্বীনিয়া বাংলাদেশ-(জাতীয় দ্বীনী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড) এর কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি কমিটিতে।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, মাত্র কয়েকজন ব্যক্তি বসে বৈঠক করে এমন কমিটির নাম ঘোষনায় মাওলানা উমর ফারুক পুরো বৈঠকে বিব্রতকর অবস্থায় ছিলেন। তিনি কয়েকবার এই কমিটি গঠনের বিষয়ে আপত্তি দিলেও হেফাজত নেতারা তাকে পাত্তা দেন নি। তিনি স্পষ্ট করেই বুঝতে পারছিলেন, তাবলীগে তাদের পাকিস্তানপন্থী আলমী শুরার কফিনে এই কমিটির দ্বারা শেষ পেরেক মারা হচ্ছে। তাবলীগে কারী যুবায়েরের নেতৃত্বাধীন ক্ষুদ্র অংশটির নিয়ন্ত্রণও আর তাদের হাতে থাকছে না।
তাবলীগ জামাতের ১শ বছরের ইতিহাসে তাবলীগ নিয়ন্ত্রণে এরকম কোন কমিটি পৃথিবীর কোন দেশে আজ পর্যন্ত কেউ করেনি বলেই জানিয়েছেন তাবলীগের মূলধারার মুরুব্বীগণ। তারা মনে করছেন, হেফাজত নেতাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ থেকেই এই কমিটি গঠন, যা নিতান্তই উদ্ভট ও হাস্যকর ছেলেমানুষী। নতুবা এর পেছনে আন্তর্জাতিক ইসলাম বিরোধী শক্তির যোগসূত্র আছে কিনা খাতিয়ে দেখা দরকার। এতে করে আরেকটু স্পষ্ট প্রমাণিত হল, তাবলীগের শ্বাসত নিয়ম ও উসুল থেকে তারা বেরিয়ে রাজনৈতিক খপ্পরে পড়েছেন তাবলীগের মূলধারা থেকে বিচ্যুত গোটি কয়েক বিদ্রোহীরা। সরকার ও সাধারণ কওমী মাদরাসার আলেমদের বিভ্রান্ত করতেই তাবলীগ পরিচালনায় শিক্ষামন্ত্রনালয় কতৃক গঠিত শিক্ষাবোর্ড হাইয়াতুল উলিয়া লিল জামিয়াতিল কওমীয়া ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় অশতিপর বৃদ্ধ অসুস্থ আহমদ শফী সাহেবের নাম বারবার ব্যবহার করছেন রাজনৈতিক নেতারা। এরদ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ ও কলংকিত করা হচ্ছে নবগঠিত এই শিক্ষাবোর্ডকে।
কেন এই কমিটি গঠন অযৌক্তিক?
কমিটি গঠনের পর থেকেই পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে দারুল উলূম উত্তরার প্রতিষ্ঠাতা, তরুণ মুবাল্লিগ মাওলানা মু’আয বিন নূর বলেনঃ
চোখের ডাক্তার দিয়ে দাঁতের চিকিৎসা হয় না। আবার দাঁতের ডাক্তার দিয়েও চোখের চিকিৎসা হয় না। দাঁতের ডাক্তার যদি চোখের চিকিৎসা করতে যায় তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? দাঁত তোলার আংটা দিয়ে চোখ তোলা ছাড়া আর তো কিছু করার থাকবে না। ঠিক এমনটিই ঘটেছে এই কথিত ‘কমিটি গঠন’এর ব্যপারে। আমরা গো-বেচারা জনগণ ভেবেছি, ডাক্তার মানেই সব বিষয়ে পারদর্শী। আলেম মানেই সব বিষয়ে অভিজ্ঞ। অথচ বিষয়টি সম্পূর্ণ বিপরীত। অনেকেই এই ‘কমিটি গঠন’এর খবরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ভাবছেন, এত এত উলামায়ে কেরাম তাবলীগের নেতৃত্বে চলে আসলে কাজের গতি-প্রকৃতি আরো বেগবান হবে। অথচ এটি চরম গুজামিলী ও ধোঁকাপূর্ণ কথা। কেননা, আলেম হলেই কেউ সবজান্তা হয়ে যায় না। আলেম হওয়ার পরও ফতোয়া দেওয়ার অধিকার অর্জন করতে হলে কয়েক বছর ‘তাখাসসুস ফিল ফিক্বহ’ পড়তে হয়। কুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হলে ‘তাখাসসুস ফিত্-তাফসীর’ পড়তে হয়। একটি আশ্চর্যজনক প্রশ্ন হলো, আলেম হওয়ার পরও কি একজন ব্যক্তি নামাজ পড়ানোর উপযুক্ত হয় না? নতুবা তাকে ‘ইমাম প্রশিক্ষণ কোর্স’ করতে হয় কেন? হিফয বিভাগের ভালো উস্তাদ যাচাই করতে হলে কেন ‘হুফফাযুল কুরআন’এর প্রশিক্ষণের কথা প্রশ্ন করা হয়? আলেম হওয়ার পরও মক্তবে ‘আলিফ-বা-তা’ পড়াতে কেন ‘নূরানী ট্রেনিং’ নিতে হয়? এত এত প্রশ্নের উত্তর হলো, ‘দাওরা’ পাশ করার অর্থ হলো, আলেম হওয়ার প্রাথমিক মানদণ্ডে উপনীত হওয়া। এরপর যে যে বিষয়ে পারদর্শী হতে চায় তাকে সে বিষয়ে সাধনা ও প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এতটুকুতো সব আলেমই মানেন। মানেন বলেই তো এসব প্রশিক্ষণ কোর্সগুলো উলামায়ে কেরাম দিয়ে টুইটম্বুর হয়ে থাকে।
তাই একথা তো আজ দ্বিবালোকের মত স্পষ্ট যে, শুধু ‘দাওরা’ পাশ করলেই সবজান্তা বা সর্বদর্শী আলেম হওয়া যায় না। প্রত্যেকের পরিধিই সীমিত। যদি আলেম হওয়ার পরও ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে সামান্য ‘আলিফ-বা-তা’ পড়াইতে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হয় তাহলে ‘দাওয়াত ও তাবলীগ’ নামে গোটা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইসলামী প্রজেক্ট চালাতে কি কোন বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন নেই? এই বিশেষ প্রশিক্ষণের নামই হলো ‘আমীরের তত্বাবধানে দাওয়াত ও তাবলীগে ১ সাল (১ বছর) দিয়ে প্রাথমিক ধারণা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করা। তারপর মহল্লার নিয়মিত কার্যক্রমে নিবীড় নিমগ্ন থাকা।’ নতুবা বিনা প্রশিক্ষণে এত বড় কাজে হাত দিলে শেষ পরিণতিতে বারবার ‘১লা ডিসেম্বব’ এর পূণরাবৃত্তি ঘটবে। তাই অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এড়াতে এখনই এই তথাকথিত ‘কমিটি’র বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন।
সচেতন চিন্তাশীল আলেমরা মনে করছেন, কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই মূলত দারুল উলুম দেওবন্দ ও গোটা বিশ্বে তাবলীগের সাথে সংশ্লিষ্ট চার মাজহাবের আলেমদের বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে বাংলাদেশে তাবলীগ নিয়ন্ত্রণের হীন ব্যর্থ চেষ্টা করে সমাজ ও রাষ্টে ধর্মীয় সংঘাত এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পায়তারা করছেন। তারা এটিও বলছেন, গুটি কয়েক ব্যক্তির এসব কমিটি গঠন এবং তাবলীগ নিয়ন্ত্রণের উচ্চাভিলাষী খায়েশ কখনো পুরা হবে না, ইনশা আল্লাহ।