বৃহস্পতিবার, ০৮ এপ্রিল ২০২১, ০৯:৫৫ পূর্বাহ্ন
ইবনে আবদে রাব্বিহী; তাবলীগ নিউজ বিডিডটকম
‘হেফাজতী’ শব্দটিকে জঘন্যতম গালি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন কাকরাইলের সাবেক শূরা মাওলানা উমর ফারুক গোপালগঞ্জী। গতকাল রাজধানীর রহিম মেটাল মসজিদে তাবলীগের ঐক্যবিরোধী সাথীদের সামনে এই বক্তব্য দেন মাওলানা উমর ফারুক। তিনি বলেন “হেফাজতী শব্দটার অর্থ যদিও খুব খারাপ না, কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানে এটা জঘন্যতম গালি হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিত।” (নীচে ভিডিও সংযুক্ত করা হয়েছে।)
একটি নির্মোহ বিশ্লেষনঃ
উল্লেখ্য যে, ২০১৩ সনে নাস্তিক্যবাদ বিরোধিতার অন্তড়ালে কতিপয় রাজনৈতিক আলেম নিজেদেরকে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত করে তোলার জন্য ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ এর ব্যানারে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৯৬ সালে নামসর্বস্ব এই গ্রুপটির জন্ম হলেও জাতীয় ইস্যুতে ২০১৩ সালের পূর্বে মাঠে নামতে দেখা যায় নি। শাপলা ট্রাজেডীর পর ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামটি গণমানুষের আবেগে পরিণত হয়। এই আবেগের সুযোগটি অতিকৌশলে কাজে লাগায় কতিপয় ধুরন্ধর রাজনীতিবীদ আলেম। জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত ‘হেফাজত’ এর ব্যানারে কোন আন্দোলন সফলতার মুখ না দেখলেও আবেগপ্রবণ সরলমনা মুসলমানদেরকে সহজেই বাগে আনার হাতিয়ার হিসেবে বারবার ব্যবহৃত হয়ে আসছে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামটি। সূচনালগ্ন থেকে দলটি অরাজনৈতিক হিসেবে দাবী করে আসলেও বর্তমানের অধিকাংশ ইসলামী রাজনীতিক নিজেদের অবস্থান পাঁকাপোক্ত করতে বারবার ‘হেফাজত’কেই ব্যবহার করে আসছেন।
আমিরে হেফাজত শুধু নামেই ছিলেন হেফাজত প্রধান। মহাসচিব ছিলেন আপদমস্তক একজন মুহাদ্দিস। আমরা তখনই বলেছিলাম, এখনো বলতে চাই, আমির এবং মহাসচিব রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দিক দিয়ে দুজনেই ছিলেন অনভিজ্ঞ। আর হেফাজত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও এবং আন্দোলনটা ধর্মীয় দাবিতে হলেও ধরণ তো বরাবরই রাজনৈতিক ছিল। রাজনীতি মানে তো শুধু ক্ষমতার জন্য কামড়া-কামড়ি নয়। অরাজনৈতিক দাবি-দাওয়া আদায় করতে আন্দোলন তো রাজনৈতিক স্টাইলেই করা লাগে। অন্যকথায়, অরাজনৈতিক দাবি আদায়ের জাতিগত উদ্যোগও একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি। হেফাজতের আশিভাগ নেতৃবৃন্দ কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। রাজনৈতিক নেতারা রাজনৈতিক ক্যালকুলেশন ছাড়া কোনো কাজ করবেন—কীভাবে হতে পারে! এক্ষেত্রে সমস্যা যেটা হয়েছিল; সেটা হচ্ছে, আমির-মহাসচিব রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ বুঝেন না; কিন্তু কাছের যারা এসব বুঝেন, তাঁরা বুঝেন তাদের মতো। জনগণের মতো করে বোঝার কেউ ছিল না।
এই পাঁচ বছরে মোটামুটি সবার চেহারাই সামনে চলে এসেছে। বড়গাছের পাতা থেকে ছোট গাছের মাথা পর্যন্ত। সবাই বুঝে গেছে, আহমদ শফীর মাথায় কাঁঠাল রেখে কারা কারা গোঁফে তেল মেখেছিলেন।
এমন একটি সম্মানজনক সংগঠন কেন আজ জঘন্যতম গালিতে পরিণত হল সে সম্পর্কে চমৎকার লিখেছেন সুলেখক রশীদ জামিল…
‘মুখোশধারীদের চিহ্নিত করে তাদেরকে ছেঁটে ফেলে দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে সামনের দিনে কপালে আরও কী কী দুর্গতি আছে—কেউ জানে না’। তখন অনেকেই মুখ বাঁকা করে তাকাচ্ছিলেন। ভাবছিলেন ঘিয়ে কাঁটা খোঁজছি। ভাবছিলেন, খামাখা দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছি। অনেকে তো সরাসরি বলেও ফেলেছিলেন, আওয়ামী লীগের হয়ে দালালি করা হচ্ছে। আমার সিলেটের এক বন্ধু ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই লেখার জন্য তুমি কত টাকা পেয়েছো? আওয়ামী লীগ তোমাকে কত টাকা দিয়ে এই লেখা লেখিয়েছে’? আমি তাঁকে বললাম, ‘ভাবতে ভালো লাগছে, আওয়ামী লীগ আমাকে পয়সা দিয়ে লেখানোর মতো লেখক আমি; আমি তাহলে কম না’!
ছয় মাস যেতে না যেতেই দেখা গেল সেই তাঁরা, যারা বলছিলেন আওয়ামী লীগের স্বার্থে হেফাজতের বিরুদ্ধে লিখে ফেলেছি; আমারচে আরও কঠিনভাবে, আরও শক্ত শব্দে অনলাইনে ক্ষোভ ঝাড়ছেন! আর আজ পাঁচ বছরের মাথায় এসে মোটামুটি একটি ব্যাপার দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার হয়ে গেছে; হেফাজতের নেতৃত্বে এমন কিছু লোক তখন প্রভাব বিস্তার করে ছিল, যাদের দায় হেফাজতকে চুকাতে হয়েছে। এমন কিছু ব্যাপার ঘটেছে তখন অন্দরমহলে, যার খেসারত দিতে হয়েছে এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের সন্তানকে; তাদের জীবন দিয়ে।
পরিষ্কার ভাষায় বলি, যারা হেফাজতকে কামাই-রুজির ধান্ধা হিসেবে ব্যবহার করেছে, যারা এ দেশের গরিব কওমি মাদরাসা ছাত্রদের মাথা বিক্রি করে খেয়েছে; কিয়ামতের দিন তারা তো ধরা খাবেই। যারা নেতৃত্বে ছিলেন বা আছেন এবং জেনে বুঝে এদেরকে ছাড় দিচ্ছেন; দায়িত্বশীলদের কথা বলছি—আল্লাহর আদালতে তারাও ছাড় পাবেন না। নবিজির দিয়ে যাওয়া ১০ নম্বর মহা সতর্কবার্তা স্মরণ রাখা দরকার, ‘সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হবে…’বিশ্বাসের বহুবচন, পৃষ্ঠা ১৯/২০
দাওয়াত ও তাবলীগের চলমান সঙ্কটে অবৈধ অনধিকার চর্চার মাধ্যমে নতুন করে ‘সঞ্জীবনী সূধা’ পান করে শাপলার পাদদেশে চুপসে যাওয়া ‘হেফাজত’। আবারো ‘গেও-গেরাম’ এর চা-ষ্টলে চুমুকে চুমুকে চায়ের কাঁপে ঝঁড় উঠে ‘হেফাজত’ নিয়ে। নতুনভাবে সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার কথা ভাবতে থাকে ‘কান নেওয়া চিলের পিছে দৌঁড়ানী’ বাহিনী। কিন্তু এবার আর হালে পানি আসে নি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ষ্পষ্ট হতে থাকে সবকিছু। গ্রাম-শহরের নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবার চোখেই ধরা পড়ে যায় ‘হেফাজত’ মুদ্রার উল্টাপিঠ।
সদ্য অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণসংযোগ ও শোডাউনের ব্যপারে বিধিনিষেধ থাকায় ‘হেফাজত’ এর ব্যনারে শুরু হয় ‘ওজাহাতি জোড়’। নামে ‘তাবলীগ’ থাকলেও কামে চলে ‘রাজনীতি’। শতবর্ষী তাবলীগের এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিজেদের ভোটার বানাতেই মূলত এতকিছু করা হয়েছিলো, যা বুঝতে সচেতন সমাজের একটুও বেগ পেতে হয় নি। ধীরে ধীরে সব পরিষ্কার হতে থাকলে ক্রমশঃ ফুঁসে উঠতে থাকে জনগণ। পরম ধৈর্যশীল নিরীহ তাবলীগকর্মীরা সবকিছু মুখ বুঁজে সহ্য করে নিলেও পায়ে পড়ে গ্যাঞ্জাম বাঁধাতে আসে হেফাজতকর্মীরা। যার ফলে গত ১লা ডিসেম্বরে রচিত হয় ইতিহাসের আরেকটি নির্মমতম অধ্যায়। কিন্তু এবার ফিরে যেতে পারে নি ‘হেফাজত’। আসমানী গযবে চিরস্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করে ধর্মের ধ্বজাধারী এই জনবিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীটি।
অবশেষে গত ২৩শে জানুয়ারীতে প্রশাসন ও তাবলীগের মুরুব্বীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তাবলীগ পরিচালনার যাবতীয় কার্যক্রমে নিষিদ্ধ করা হয় ‘তৃতীয় পক্ষ’খ্যাত ‘হেফাজতে ইসলাম’কে। এরপর থেকে সর্বশান্ত এই গ্রুপটি ভিতরে ভিতরে জ্বলে পুড়ে কয়লা হতে থাকে। আবারো ঘুরে দাঁড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা হিসেবে লেলিয়ে দেয় কাকরাইলের সাবেক শূরা উমর ফারুককে। তারই অংশহিসেবে তিনি এই বক্তব্য তাবলীগ করি।
দারুল উলুম উত্তরার মুহতামিম মাওলানা মু’আয বিন নূর বলেন, ‘হেফাজত’ এর দীর্ঘদিনের আকাশচুম্বী সুনাম, সুখ্যাতি, ভালোবাসা ও আবেগ, সবই ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে মাত্র ক’দিনের দুষ্কর্মের কারনে। আমি নিজেও ‘শাপলা ট্রাজেডী’র সময় স্পটে ছিলাম। রাত আড়াইটায় নেতাদের সাথে ওয়াপদা মাদরাসায় যাই। আমার সামনে থেকেই নেতারা রাত সাড়ে তিনটায় ‘মিটিং করতে উপরে যাচ্ছি’ বলে এলাকা ত্যাগ করে পালিয়েছিলো। আমি সেদিনের রাজসাক্ষী।
মু’আয বিন নূর আরো বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম’ শব্দটি কেয়ামতের অন্যতম একটি আলামত। সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে “سيأتي على الناس سنوات خداعات” অর্থাৎ “অতিসত্বর এমন ধোঁকাবাজ যমানা আসবে, যখন সত্যবাদীকে মিথ্যাবাদী এবং মিথ্যাবাদীকে সত্যবাদী মনে করা হবে। বিশ্বস্তকে অবিশ্বস্ত এবং অবিশ্বস্তকে বিশ্বস্ত মনে করা হবে………।” অর্থাৎ প্রতিটি বিষয়ে বাস্তবতা হবে মানুষের ধারণার বিপরীত। সহজে বললে “নামের বিপরীত কাম”। অনুরূপভাবে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামটিও এর ব্যতিক্রম নয়। যদিও নাম হচ্ছে ‘ইসলামের হেফাজত’ কিন্তু বাস্তবে কাম হলো ‘ইসলামের মুণ্ডুপাত’। শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বে আল্লাহর কালিমাকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে অদ্বিতীয় মেহনত করে আসছে নিযামুদ্দীন কতৃক পরিচালিত ‘দাওয়াত ও তাবলীগ’ জামাত। অথচ এই ‘হেফাজতে ইসলাম’ সেই মহান দ্বীনী অভিযানের বিরুদ্ধে লেগেছে। তাবলীগকে ‘হেফাজত’ করার দাবী করলেও বাস্তবে এই মুবারক মেহনতকে খানখান করে দিয়েছে এই ‘মুণ্ডুপাতে ইসলাম’। এখানেও আমরা গো-বেচারা জনসাধারণ উপরোক্ত হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী মিথ্যবাদীদেরকে সত্যবাদী ভেবে তাদের পেছনে ছুুটছে।
ইলিয়াস রাহ. বলতেন, আমার এই মেহনত হলো, দুই ফলাবিশিষ্ট ধারালো তরবারীর মত। যে-ই খেলতে আসবে সেই কাটা পড়বে। আর এই কথাটা হাদীস থেকেও প্রমাণিত। রাসূল যখন পারস্যের বাদশাহ ‘মুক্বাওক্বিস’ এর নিকট চিঠি পাঠালেন তখন সে রাসূলের চিঠি ছিড়ে ফেলে। এই সংবাদ শুনে রাসূল বলেছিলেন, ‘ফারেস’ আমার চিঠি ছিড়ে নাই। সে তার রাজত্য ছিড়ে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। “اللهم مزق ملك فارس كل ممزق” রাসূলের এই দুআ আজোবধি তার রেখে যাওয়া মেহনতের জন্য ক্ববূল হয়ে আছে। অতএব, এই মেহনতের বিরুদ্ধে যে লাগবে সে নিজেই অপারেশন হয়ে যাবে।