বৃহস্পতিবার, ০৮ এপ্রিল ২০২১, ০১:৫১ অপরাহ্ন
কওমী শিক্ষাবোর্ড প্রতিনিধি, তাবলীগ নিউজ বিডিডটকম
আবার সারাদেশে ব্যাপক সমালোচিত বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ। কয়েকটি মাদরাসার সাথে অন্যায়, বৈষম্যমুলক আচরণের কারণে হাইকোর্টে রীট করার পরে বেফাকের সিদ্ধান্ত বদল ও ভুক্তভুগী মাদরাসাগুলোর ব্যপারে নতুনভাবে প্ররীক্ষা প্রস্তুতির ঘোষণা নিয়ে চলছে আলোচনার ঝড়। বেফাক বোর্ডের মুষ্টিমেয় কয়েকজনের বারবার সিদ্ধান্ত বদলের নাটকীয়তা ও হাইকোর্টের ভর্ৎসনার কারনে লজ্জিত হতে হচ্ছে গোটা কওমী অঙ্গনকে। পাশাপাশি অনেক গুরুত্বপূর্ণ দ্বায়িত্বশীলদের আপত্তির পরেও কয়েকজন সাহেবজাদা ও তাদের দলীয় নেতাদের একঘেঁয়েমির বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে।
এখন আবার নতুন করে দেশের বৃহৎ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক) এর স্বজনপ্রীতি ও রাজনীতিকরণের অজানা কথাগুলো উঠে এসেছে প্রকাশ্য আলোচনায়। আত্মীয়করণ ও ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে পুরো প্রতিষ্ঠানটি কতিপয় সাহেবজাদাদের হাতে জিম্মী করে রাখার অজানা তথ্যগুলো তুলে ধরছেন খোদ বেফাক সংশ্লিষ্ট একাধিক দ্বায়িত্বশীল। তারা বেফাককে আত্মীয়করণ ও রাজনীতিকরণ থেকে মুক্ত করার দাবী তুলছেন। তারা বর্তমান কমিটি ভেঙ্গে নতুন কমিটি চান, এমনটিও জানিয়েছেন আরো একাধিক বেফাকনেতা।
কিছু অসাধু ব্যাক্তি আত্মীয়করণ করে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার নীতিনির্ধারক হয়ে বসে আছে। নিজেদের সিদ্ধান্তগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য তারা বয়োবৃদ্ধ মুরুব্বীদের কাছে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করে মনগড়া আইন বানিয়ে নেয়। তাদের হাতে আজ গোটা কওমী অঙ্গন জিম্মি। এসব নষ্টের মূল মাত্র কয়েক সাহেবজাদা ও তাদের সমমনা দোসররা। তাদের অন্যায় আচরণ, নিয়ম বহির্ভূত সিদ্ধান্ত, একগুঁয়েমি ও নিজেদের স্বার্থবাজির কারনে আজ চরম মানহানিকর পরিস্থিততে পড়তে হচ্ছে গোটা কওমী সমাজকে।
জানা যায়, আগের কমিটির তুলনায় কলেবরে বাড়ানো হয়েছে বর্তমান কমিটির সদস্য সংখ্যা। তবে স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। অনেকেই বলছেন, ‘দ্বীনি শিক্ষায় স্বজনপ্রীতির বিরোধিতা করা হলেও এ ধরনের চর্চা দেশের সবচেয়ে বড় কওমি প্রতিষ্ঠানটিকে সঠিকভাবে পরিচালিত হতে বারবার বাধাগ্রস্ত করছে।’ শিক্ষা ও শিক্ষামূলক গবেষনা কার্যক্রম বাধ দিয়ে, হেফাজতকে বিতর্কৃ্ত করার পর, নানান বিতর্কৃত বিষয় সরাসরি বেফাকের নামে কওমী শিক্ষার্থীদের মিছিল মিটিং সহ বিভিন্ন কাজে ব্যাবহার করছেন কতিপয় ব্যাক্তি।
হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী গত ১০ বছর ধরে সভাপতির পদে আছেন। নির্বাহী কমিটিতে আছেন ১১৬ জন, শুরা কমিটিতে আছেন ২৪২ জন। পদাধিকার বলে নির্বাহী কমিটির ১১৬ জন সদস্য শুরা কমিটিতেও অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। আল্লামা আহমদ শফী বয়োবৃদ্ধ এবং একই সাথে হেফাজত ও হাইয়াতুল উলয়ার সভাপতি হওয়ায় কতিপয় ছাহেবজাদা তাকে প্রভাবিত করে হেফাজতের আন্দোলনমুখী কাজ বেফাকের নামে চালিয়ে দিতে চান।
এদিকে কতিপয় ছাহেবজাদের প্রভাবে বোর্ডের গত কাউন্সিলে ঘোষিত নতুন কমিটিতে জায়গা দেওয়া হয়েছে প্রভাবশালী আলেমদের আত্মীয়স্বজনকে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিরাও বেফাকের দায়িত্বশীল পদ পেয়েছেন।
জানা যায়, বিগত কাউন্সিলে ঘোষিত নির্বাহী কমিটিতে ২৭ জনকে সহ-সভাপতি করা হয়েছে। এছাড়া সহকারী মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছেন আটজন।
জানা গেছে, বেফাকের সভাপতি শাহ আহমদ শফীর ছেলে মাওলানা আনাস মাদানীকে সহ-সভাপতি ও তার জামাতা মাওলানা ইসহাককে সদস্য করা হয়েছে। মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুসের ভগ্নিপতি মুফতি নুরুল আমীনকে যুগ্ম মহাসচিব ও মহাসচিবের ভাই মাওলানা আব্দুল কাদিরকে সদস্য করা হয়েছে। মহাসচিবের বেয়াই মুফতি নেয়ামতুল্লাহকে যুগ্ম মহাসচিব পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মুফতি নেয়ামতুল্লাহ একইসঙ্গে আরেক যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হকের ভগ্নিপতি।
অন্যদিকে যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হকের ভাই মামুনুল হককে সদস্য করা হয়েছে। বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা আশরাফ আলীর জামাতা মাওলানা আতাউল্লাহ আমিনকে সদস্যপদ দেওয়া হয়েছে। সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন সহ-সভাপতি মুফতি ওয়াক্কাসের ছেলে মাওলানা রশিদ আহমদ। মাওলানা মাহমুদুল হাসান সহ-সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন আর তার জামাতা মাওলানা নেয়ামত উল্লাহ ফরীদিকে শুরা কমিটির সদস্য করা হয়েছে।
আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানী বেফাকের সহ-সভাপতি পদ পেলেও হেফাজতের মহাসচিব ও শায়খুল হাদিস হাফেজ জুনাইদ বাবুনগরীকে বেফাকের মজলিসে আমেলার সদস্যপদ দেওয়া হয়েছে। আহমদ শফীর নিয়ন্ত্রণাধীন ‘আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলামের (হাটহাজারী মাদ্রাসা) অন্যতম প্রধান মুহাদ্দিস হলেন জুনাইদ বাবুনগরী। বয়োজেষ্ঠ না হয়েও একই মাদ্রাসার শিক্ষক আনাস মাদানী শুধু শফীর ছেলে হওয়ায় এই পদ পেয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া তার প্রভাবে তার একনিষ্ঠ সমর্থিত বলয়ের অনেক জুনিয়ররা সহ সভাপতি সহ সিনিয়রদের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
বিগত কমিটি গঠনের পরে ময়মনসিংহের বিভিন্ন মাদ্রাসার মুহতামিমের (প্রধান শিক্ষক) মতবিনিময় সভা হয়। সেখানে ইত্তেফাকুল উলামা বৃহত্তর ময়মনসিংহের মজলিসে আমেলার সভাপতি বেফাকের সহ সভসপতি খালেদ সাইফুল্লাহ সাদী বেফাকের কমিটি বাতিলসহ ছয় দফা দাবি পেশ করেন। সভায় বেফাকে আত্মীয়করণের সমালোচনা করে তারা এমন কমিটির বিলুপ্তি চেয়েছিলেন। এখন অনেকেই মনে করছেন তখন তাদের কথায় গুরুত্ব নাম দেয়ার খেসারত দিতে হচ্ছে এই সুনাম্যাত শিক্ষাবোর্ডকে আজ।
বেফাকে রাজনীতিকরণ
বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের নেতারা বেফাকের গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, এসব নেতার কারণে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার হচ্ছে কওমি মাদ্রাসা ও মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বেফাকের নির্বাহী কমিটিতে রয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামা ইসলাম, খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা। আগের নির্বাহী কমিটির চেয়ে এবার আরও বেশি স্থান পেয়েছেন রাজনৈতিক নেতারা।
বেফাকের মজলিসের আমেলার তালিকায় দেখা গেছে, বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি আল্লামা আশরাফ আলী হলেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের অভিভাবক পরিষদের চেয়ারম্যান। বেফাকের সহ-সভাপতির মধ্যে রয়েছেন জমিয়তে মহাসচিব মাওলানা নূর হোসেন কাসেমী, জমিয়তের একাংশের আমির মুফতি ওয়াক্কাস, ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা মাওলানা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমির মাওলানা আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী হুজুর, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ।
বেফাকের সহকারী মহাসচিবদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মাহফুযুল হক, যুব খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা মামুনুর হক। জমিয়তের সহকারী মহাসচিব মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সাদী, জমিয়তের ঢাকা মহানগরের নেতা মাওলানা কেফায়েতুল্লাহ আজহারী। ইসলামী ঐক্যজোট থেকে জমিয়তে যোগ দেয়া দলের সহ-সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ মধুপুরের পীর।
বেফাকের সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে রয়েছেন ইসলামী ঐক্যজোট নেতা মাওলানা ওবায়দুর রহমান, ইসলামী ঐক্যজোট নেতা আনওয়ারুল করিম, জমিয়ত একাংশের কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা রশীদ আহমাদ, জমিয়ত নেতা মাওলানা মাসউদুল করীম।
বেফাকের আমেলার সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন ইসলামী ঐক্যজোটের ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল হাসনাত আমিনী, জমিয়ত নেতা মাওলানা মাসউদুল করীম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নেতা মাওলানা সাঈদ নূর, খেলাফত মজলিসের সহ-সভাপতি মাওলানা যুবায়ের আহমাদ চৌধুরী, ইসলামী আন্দোলনের নেতা নূরুল হুদা ফয়েজী, ইসলামী ঐক্যজোট নেতা মাওলানা গোলাম রহমান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সহ-সভাপতি মাওলানা যোবায়ের রহমান, ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা মাওলানা লেহাজ উদ্দীন, মাওলানা নুরুল ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব আতাউল্লাহ আমিন, জমিয়ত একাংশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম।
বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসা ও বেফাক সূত্রে জানা গেছে, বেফাকের প্রতিষ্ঠাকালীন গঠনতন্ত্রে মূলনীতি ছিল—কোনও দলের শীর্ষ নেতাদের কেউ বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল পদে থাকতে পারবেন না। তবে নব্বই দশকে এরশাদ সরকারের পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় এলে রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রভাব বিস্তার শুরু হয় বেফাকে। বেফাকের মজলিসে আমেলায় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক স্বার্থে বেফাককে ব্যবহার করেন নেতারা। বেফাকে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগেও রয়েছে রাজনৈতিক দলের প্রভাব। তথ্যঃবাংলা টিউব্রোন
বেফাকের সহ-সভাপতি আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ মনে করেন বেফাক দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে থাকবে। হয়তো তাদের রাজনীতি ছাড়তে হবে অথবা বেফাক ছাড়তে হবে।’তিনি একটি অনলাইনে দেয়া সাক্ষাৎকারে আরও বলেছেন, ‘আমার অনেক দিনের দাবী, বেফাককে দলীয় রাজনীতি মুক্ত করা। এখন যেহেতু সম্মিলিত বোর্ড হয়েছে তাই এখন বেফাক দলীয় লোকজন মুক্ত হোক এটাই আমার চিন্তা-ভাবনা।
কওমি বোর্ডের প্রধান আল্লামা আহমদ শফীর পুত্রকে কমিটিতে জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘন ঘটিয়ে শীর্ষ পদ দেওয়ায় প্রতিষ্ঠানের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ কারণে বেফাকের দশম কাউন্সিল বাতিলের দাবি তুলেছেন আলেমরা।
এরপর আবার তার নেতৃত্বে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিশেষ কমিটিও গঠন করা হয়।
১৩ সদস্য বিশিষ্ট উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিশেষ কমিটিও গঠন করা হয়। এটি যেন কমিটির ভিতর আরেক কমিটি। এনিয়ে বেফাক তিন কমিটি পরিচালনা করছে। এই কমিটির সদস্যরা হলেন মাওলানা আশরাফ আলী, মাওলানা আনোয়ার শাহ, মাওলানা মুফতি ওয়াক্কাস, মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী, মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস ফরিদাবাদ, মাওলানা নূরুল ইসলাম, মাওলানা সাজেদুর রহমান, মাওলানা মাহফুজুল হক, মাওলানা মুফতি নূরুল আমীন, মাওলানা আব্দুর রর, মাওলানা মুহাম্মদ আনাস মাদানী,মাও মুসলেহ উদ্দীন। এযেন কমিটির ভিতর আরেক কমিটি। এনিয়ে বেফাক তিন কমিটি পরিচালনা করছে। এই কমিটির সদস্যরা হলেন মাওলানা আশরাফ আলী, মাওলানা আনোয়ার শাহ, মাওলানা মুফতি ওয়াক্কাস, মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী, মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস ফরিদাবাদ, মাওলানা নূরুল ইসলাম, মাওলানা সাজেদুর রহমান, মাওলানা মাহফুজুল হক, মাওলানা মুফতি নূরুল আমীন, মাওলানা আব্দুর রর, মাওলানা মুহাম্মদ আনাস মাদানী,মাও মুসলেহ উদ্দীন। এযেন কমিটির ভিতর আরেক কমিটি। এনিয়ে বেফাক তিন কমিটি পরিচালনা করছে। কিন্তু ১৩জনের মধ্যে ২/৩ জনই সব নিয়ন্ত্রণ করছেন। তারাই এখন সবকিছুর নাটেরগুরু।