বৃহস্পতিবার, ০৮ এপ্রিল ২০২১, ০১:০৫ পূর্বাহ্ন
মাওলানা সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ,তাবলীগ নিউজ বিডিডটকম
মুসলমানদের জন্য রমজান মাস এক অফুরন্ত নেয়ামত। এ মাসে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন নাজিল হয়েছে। ১১ মাস যেভাবে মানুষ জীবনযাপন করে। অফিস-আদালত চলে। বস অধীনদের কাছে থেকে যেভাবে কাজ বুঝে নেন। রমজানে তার থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম হয়। হাদিসে রমজানে অধীনদের কাজের বোঝা হালকা করতে বলা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা রমজানে অধিনস্তদের কাজকর্ম শিথিল করে দাও। তারা যেন রমজান মাসের ইবাদত যথাযথভাবে করতে পারে। যারা রমজানে কর্মচারীর প্রতি সদয় আচরণ করবেন, তাদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে।
গৃহভৃত্য, পরিচারিকা ও অধিনস্ত কর্মচারীরাও যে আল্লাহর বান্দা, রমজান মাসে যেন লোকেরা সে কথা ভুলে যায়। তাদের খাটুনির মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অথচ হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে নবী করিম (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘তোমরা মাহে রমজানে কর্মচারীদের কাজকর্ম শিথিল করে দাও। তারা যেন রমজান মাসের ইবাদত যথাযথভাবে করতে পারে।’ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মানবতার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। তিনি ক্রীতদাসদের কষ্ট নিজে ভাগ করে নিতেন। বিপদে-আপদে তাদের পাশে দাঁড়াতেন। একবার এক গোলাম গম পিষছিল আর কাঁদছিল। নবীজি তার কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলল, ‘প্রতিদিন তাকে এক মণ গম পিষতে হয়। আজ শরীরটা খুব অসুস্থ, তাই পিষতে পারছি না। আমার মনিব বড়ই নিষ্ঠুর লোক। গম পিষতে পারছি না দেখলে হয়তো সে আমাকে মারবে, এই ভয়ে কাঁদছি।’ রাহমাতুল্লিল আলামিন গোলামটির পাশে বসে তার গমগুলো পিষে দিলেন এবং বললেন, ‘ভবিষ্যতে যখনই তোমার কষ্ট হবে আমাকে খবর দিবে। আমি এসে তোমার কাজ সম্পন্ন করে দিব।’
কোনো ক্রীতদাসের অসুস্থতার খবর শুনলে নবীজি ছুটে যেতেন এবং তার সেবা-শুশ্রুষা করতেন। একবার এক ধনী লোকের জনৈক গোলাম অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাকে দেখার কেউ ছিল না। মনিব ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির। গোলামটি একটি অন্ধকার কুঠুরিতে শুয়ে কাতরাচ্ছিল। দয়াল নবীজি ওই বাড়ির কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় অসুস্থ গোলামটির কাতরানির আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি সেখানে উপস্থিত হয়ে তার মাথায় হাত বোলাতে থাকেন। এতে সে আরাম বোধ করতে লাগল। রাতে সে নবীজিকে চিনতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, তার মনিব তাকে সেবার জন্য পাঠিয়েছেন কি না। নবীজি বললেন, ‘তিনি স্বেচ্ছায়ই এসেছেন।’ পরদিন সকালে ওই ক্রীতদাস যখন দেখল যে নবীজি তার সেবা করছেন, তখন সে কেঁদে উঠল। ভাবতে লাগল, মানুষের জন্য মানুষের এত দয়া, এত ভালোবাসা? আমি একজন গোলাম, অথচ দোজাহানের বাদশাহ হয়েও নবীজি আমার সেবা করছেন? এই ছিল মহানবী (সা.)-এর সুমহান আদর্শ।
হাদিসে বলা হয়েছে, রমজানে যারা অধীনদের প্রতি সদয় ব্যবহার করেন অর্থাৎ তাদের কাজের বোঝা হালকা করেন, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেন এবং জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করেন। বাসার কাজের লোক বলে কাউকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা যাবে না। পেশা তার বাসার কাজ হতে পারে। হতে পারে দারোয়ান, মালি, বাবুর্চি, কেয়ারটেকার। আল্লাহর কাছে তার মর্যাদা কম নয়। রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘হে লোক সব! আল্লাহ তোমাদের ভাইদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। অতএব যার অধীনে কোনো ভাই থাকে, তাকে তা-ই খাওয়াবে, যা সে নিজে খায়, তাকে তা-ই পরাবে, যা সে নিজে পরে এবং তাকে সাধ্যের অধিক কাজ চাপিয়ে দেবে না। অগত্যা তাকে যদি কোনো কষ্টের কাজ করাতে হয়, তাহলে তাকে সাহায্য করবে।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
শুধু সদয় ব্যবহার নয়। রমজানে অধীনদের সঠিক মজুরি দিতে হবে এবং সেটা উপযুক্ত সময়ে। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি দিয়ে দাও।’ (ইবেেন মাজাহ)। পেশার মধ্যে ছোট-বড় হতে পারে। সেজন্য আমাদের আচরণে যেন ভেদাভেদ না হয়। শ্রমজীবীদের রমজানে যারা সাহায্য করবেন, অধীনদের কাজের বোঝা হালকা করবেন, তারা নিশ্চিতভাবে আল্লাহর রহমত পাবেন।
রাসুল (সা.) বলেছেন, যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকবে, আল্লাহ তার ওপর রহমতের ডানা প্রসারিত করবেন এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। এক. দুর্বলের সঙ্গে নম্র ব্যবহার। দুই. মা-বাবার সঙ্গে কোমল ব্যবহার। তিন. দাস-দাসীর প্রতি সদাচরণ। (তিরমিজি)।
শ্রমিককে তার উপযুক্ত মজুরি দিতে হবে। যারা সঠিকভাবে শ্রমিককে পারিশ্রমিক দেয় না, তাদের পরিণতি ভয়াবহ। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির প্রতিপক্ষ হব। তার মধ্যে একজন হচ্ছে, যে ব্যক্তি কোনো শ্রমিককে কাজে নিয়োগ করে বটে; কিন্তু তার মজুরি পরিশোধ করে না।’ (বোখারি)।
রমজানে মাঝামাঝি সময় থেকেই পত্রিকায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের হাহাকার চোখে পড়ে। বেতন-বোনাস ঠিকমতো পাওয়া নিয়ে তারা আতঙ্কে ভোগেন। সঠিক সময়ে বেতন-বোনাস পান না। এটা রমজানের শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত। রাসুল (সা.) এর হাদিসের বিপরীত। নিজে নামাজ-রোজা করলাম অথচ মানুষ ঠকালাম, বোনাস কেটে রাখলাম, অফিস ছুটির পরও বসিয়ে রাখলাম, কর্মচারীদের ছুটি দিলাম না, কাজের বোঝা হালকা করলাম না এমনটা যেন না হয়।