শনিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২১, ০৪:৪৪ পূর্বাহ্ন
মাওলানা আহমদ জামিল, তাবলীগ নিউজ বিডিডটকম। তাবলিগ জামাতের বর্তমান পদ্ধতি হজরতজী মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর হাত ধরে ১৯২০ সালে ভারতের মেওয়াত অঞ্চলে শুরু হয়। ১৯৪৪ সালের ১২ জুলাই তিনি ইন্তেকাল করলে তার সুযোগ্য পুত্র মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী (রহ.) তাবলিগের বিশ্ব আমীর হন। মাওলানা ইউসুফ (রহ.)-এর আমলে তাবলিগের কাজ বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করে।
এ সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়মিত জামাত পাঠানো শুরু হয়। ১৯৬৫ সালে তার ইন্তেকাল হলে মাওলানা এনামুল হাসানকে (রহ.) তৃতীয় হজরতজী নির্বাচন করা হয়। তিনি মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর ভাগ্নে ও ইউসুফ (রহ.)-এর মামাতো ভাই ছিলেন। মাওলানা এনামুল হাসান (রহ.) শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লে তাবলিগের আগামীর নেতৃত্বের বিষয়টি উঠে আসে। ১৯৯৫ সালে তৃতীয় হজরতজী মাওলানা এনামুল হাসান (রহ.) ইন্তেকাল করেন।
এ সময় দু’জন ব্যক্তির কথা আলোচিত হয়। এনামুল হাসান (রহ.)-এর ছেলে মাওলানা জুবাইরুল হাসান ও হজরতজী ইউসুফ (রহ.)-এর নাতি মাওলানা সাদ কান্ধলভী। মাওলানা জুবাইরুল হাসান (রহ.) ছিলেন প্রবীণ, আর মাওলানা সাদ ছিলেন বয়সে ছোট। জুবাইরুল হাসান (রহ.) বর্তমান আমীরের ছেলে হলে মাওলানা সাদ হলেন ইলিয়াস (রহ.)-এর বংশধর। আর মেওয়াতি যাদের হাতে তাবলীগের প্রাথমিক কাজের সূচনা তারা প্রথম থেকেই একক আমীর হিসাবে মাওলানা সাদ’ কেই চাচ্ছিলেন।
তাই একক আমীর নির্ধারণ করা তখন অনেকটাই জটিল হয়ে ওঠে। অবস্থায় মাওলানা এনামুল হাসান (রহ.) মৃত্যুর কয়েকদিন আগে ১৯৯৫সালে আমির নির্ধারনের জন্য তখন ১০ জনের একটি জামাত বানান। বিশ্বের সেরা দশজন তাবলীগ মনীষীর মধ্যে তখন মাওলানা সাদ সাহেবও ছিলেন।
পরে দশজন মিলে একজন আমীর নির্ধারন করতে ব্যার্থ হন এবং দশজন থেকে ফায়সাল বা আমীর হিসাবে নির্ধারণ করেন তিনজনকে। মাওলানা ইজহারুল হাসান(সাদ সাহেবের আপন নানা) মাওলানা জুবাইরুল হাসান, মাওলানা সাদ কান্ধলভী। এক বছরের মাথায় ১৯৯৬ সালে ইন্তেকাল করেন মাওলানা ইজহারুল হাসান (রহ.)।
এরপর থেকে তাবলিগের বিশ্ব ফায়সাল হিসেবে কাজ করতে থাকেন মাওলানা জুবাইরুল হাসান (রহ.) ও মাওলানা সাদ কান্ধলভী। শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা ও অভ্যাসগতভাবে মাওলানা জুবাইরুল হাসান বেশি সময় বয়ান করতে পারতেন না। তাই বিশ্বের বিভিন্ন ইজতেমা ও মাশওয়ারাগুলোতে তিনি শেষ মোনাজাত করতেন। মূল বয়ান ও গুরুত্বপূর্ণ বিষায়াবলীর ফায়সালা করতেন মাওলানা সাদ। এভাবেই চলছিল বিশ্বব্যাপী তাবলিগের কার্যক্রম।
তাবলিগের বিশ্ব মার্কাজ হল নিজামুদ্দীন। আর পাকিস্তানের রাইবেন্ড ও বাংলাদেশের কাকরাইল হল সহযোগী মার্কাজ। নিজামুদ্দীন মার্কাজের মূলে ছিলেন মাওলানা জুবাইরুল হাসান (রহ.) ও মাওলানা সাদ কান্ধলভী। বিগত ২৫ বছর ধরে টঙ্গীর ইজতেমা ও রাইবেন্ড ইজতেমার মূল বয়ান ও হেদায়াতি কথা বলতেন মাওলানা সাদ আর দোয়া পরিচালনা করতেন মাওলানা জুবাইরুল হাসান।
২০১৪ সালের মার্চে আকস্মিকভাবে মাওলানা জুবাইরুল হাসানের ইন্তেকাল হলে তৃতীয় হজরতজীর রেখে যাওয়া শূরাদের একমাত্র জীবিত ফায়সাল থাকেন মাওলানা সাদ কান্ধলভী। মাওলানা সাদের পরিচালনায় বিশ্বব্যাপী তাবলিগ জামাত গত ২০ বছর ধরে পরিচালিত হয়ে আসছে। তাবলীগের বিশ্বব্যাপি জাগরণ ও নানান সংস্কারমূলক কাজ তার হাত ধরেই সূচিত হয়।
২০১৫ সালে রায়ভেন্ড ইজতেমার সময় পাকিস্তানের কিছু মুরুব্বী যারা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের নিজামুদ্দিন মারকাজ ও মাওলানা সাদ এর নেতৃত্ব মানতে পারছিলেন না, এবং নিজদের নেতৃত্ব লাভের নেশায় আলমি শূরা নামে আমীর ছাড়া একটি কমিটি বানানোর প্রস্তাব করেন। তাবলিগের ইতিহাসে এ এক নতুন উদ্ভাবন। বাংলাদেশের মুরব্বিদের পক্ষ থেকে মাওলানা জুবায়ের বিষয়টি সরাসরি অস্বীকার করে দৃঢ়কণ্ঠে বলেন- তাবলিগের মার্কাজ নিজামুদ্দীন,এটি নিজামুদ্দিন মারকাজের ক্ষমতাকপ খর্ব করার শামিল।
আলমি কোনো ফায়সালা হলে সেখানেই হবে। পাকিস্তানে কেন? নিজামুদ্দীনের মুরব্বিরাসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মুরব্বিরা এতে সমর্থন জানাননি। এখানে মনে রাখতে হবে, তাবলিগের আলমি কোনো ফায়সালা রাইবেন্ডে হয় না। তাই মুরব্বিরা এটিকে বিশ্বব্যাপী নিজামুদ্দীনের কেন্দ্রীয় মর্যাদা খর্বের চেষ্টা হিসেবে দেখলেন।
এ ছাড়া ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় তাবলিগের আলমি মার্কাজ নিজামুদ্দীন থেকে রাইবেন্ড নেয়ার ব্যাপারে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতারা চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হজরত হুসাইন আহমদ মাদানি (রহ.), আবদুল কাদের রায়পুরী (রহ.) ও শাইখ যাকারিয়া (রহ.)-এর সম্মিলিত সিদ্ধান্তে বিশ্ব মার্কাজ নিজামুদ্দীনই রয়ে যায়।
হজরতজী ইলিয়াস (রহ.)-এর বংশের চতুর্থ পুরুষ মাওলানা সাদ কান্ধলভীর হাতে এখন তার পূর্বসূরীদের আমানত অর্পিত হয়েছে। মাওলানা সাদের বংশ পরিক্রমা হল- সাদ ইবনে হারুন ইবনে ইউসুফ ইবনে ইলিয়াস। এটি ইসলামের মহান খলিফা হযরত আবুবককর রা. এর সাথে গিয়ে মিলত হয়েছে।
২০১৭ সালের বিশ্ব ইজতেমায় বিশ্বের সকল দেশের শূর সম্মিলিত সিদ্ধান্তে তিনি তাবলিগ জামাতের বর্তমান আমির। শুধু পাকিস্তানের কিছু বিদ্রোহী ছাড়া সবক’টি দেশে নিজামুদ্দীনের অধীনে মেহনত পরিচালিত হচ্ছে। পরে পাকিস্তানের এই চক্রান্তের সাথে যুক্ত হন বাংলাদেশের কিছু আলেম। অতপর তাকে আমীর থেকে সড়াতে তারা নতুন পন্থা আবিস্কার করেন। বিগত ২০বছর সারা দুনিয়ার কোন আংপম তার একটি ভুল না ধরলেও হঠাৎ তার বয়ান কাটপিচ করে আলেমদের সামনে এনে সাদ সাহেবের ব্যাপারে তাদের খেপিয়ে তুলে এই চক্রটি।
মাওলানা সাদ যুগচাহিদা ও বাস্তবতার কারণে তাবলিগের অনেক বিষয়ে নতুনভাবে মনোনিবেস করেন। গত ২০ বছরে তিনি তাবলিগের কথাবার্তা, মেহনতের ধরনে কিছুটা নতুনত্ব আনেন। বিষয়গুলো বিশ্বে ব্যাপক ফলদায়ক ও প্রশংসিত হয়েছে। যেমন মসজিদ আবাদির মেহনত, ফাজায়েলে আমলের পাশাপাশি মুন্তাখাব হাদিসের তালিম ইত্যাদি। তা ছাড়া মাওলানা সাদ গতানুগতিক বয়ানের পাশাপাশি অনেক গবেষণালব্ধ কথাও বলেন।
যা বিগত ইজতেমাগুলোতে মেহনতের সাথীরা খুব গুরুত্বের সঙ্গে নোট করতেন। মার্কাজগুলোতে বিশেষভাবে তার বয়ানের মোজাকারাও হতো। একজন মানুষের কথাবার্তা ও গবেষণায় ভুল হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
মাওলানা সাদের কয়েকটি বক্তব্যে দারুল উলুম দেওবন্দ আপত্তি জানায়। লিখিতভাবে তিনি সে বক্তব্যগুলো প্রত্যাহার করেন। গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ থেকে আলেম ও তাবলিগের শূরাদের একটি প্রতিনিধি দল ভারত সফর করে।
মাওলানা সাদের ওপর দেওবন্দ সন্তুষ্ট কিনা? এর পরিপ্রেক্ষিতে দেওবন্দ কর্তৃপক্ষ জানান, যেহেতু সাধারণ মানুষের মজমায় ভুল বক্তব্য দেয়া হয়েছিল, সে ভুলের ক্ষমাও প্রকাশ্য মজমায় চাইতে হবে। প্রতিনিধি দলকে দেওবন্দের দেয়া শর্তের ভিত্তিতে মাওলানা সাদ সেদিনই তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। গত ২৫ ডিসেম্বর তাবলিগের বিশ্ব মার্কাজ নিজামুদ্দীনের মিম্বরে মাওলানা সাদ তার বিতর্কিত বক্তব্যগুলো থেকে প্রকাশ্য রুজু করেছেন।
মাওলানা সাদের বিরোধীরা দেওবন্দের পর্যবেক্ষণকে তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে ব্যবহার করায় কথা উঠেছিল, দেওবন্দ মাওলানা সাদের আমীর হওয়ার বিরুদ্ধে। তারাও শূরার পক্ষে। কিন্তু ইনসাফের মূর্তপ্রতীক দেওবন্দ কর্তৃপক্ষ নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন।
গত আগস্ট ১৭ ইং সম্মিলিত সিদ্ধান্তে তারা জানান, তাবলিগের বিবদমান উভয়পক্ষের কারও সঙ্গেই দেওবন্দের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি তাবলিগ জামাতের একান্ত অভ্যন্তরীণ বিষয়। বিষয়টি যেহেতু শরিয়তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, তাই দেওবন্দ এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করবে না। এবং যতদিন তাবলিগের অভ্যন্তরীণ এ সমস্যা শেষ না হবে, দারুল উলুমের ভেতর তাবলিগের সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। মূলত তাবলিগের ইমারত ও শূরার প্রশ্নে দারুল উলুম দেওবন্দ নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করেছে। এতক্ষণের আলোচনায় দুটি বিষয় উঠে এসেছে-
১. দেওবন্দের দৃষ্টিতে ব্যক্তি মাওলানা সাদের আপত্তিকর কিছু বক্তব্য।
২. তাবলিগের অভ্যন্তরীণ ইমারত ও শূরার দ্বন্দ্ব।
দারুল উলুম দেওবন্দ প্রথম বিষয়ে নিজেদের সম্পৃক্ত করে দ্বিতীয় বিষয়ে কোনো পক্ষাবলম্বন না করলেও বাংলাদেশের কিছু আলেম দেওবন্দের দোহাই দিয়ে ব্যক্তি মাওলানা সাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
মাওলানা সাদের রুজুর বিষয়টি তারা এড়িয়ে গিয়ে তার অপসারণ দাবি করেছেন। বাংলাদেশের সব তাবলিগি সাথীদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার গত ইজতেমায় মাওলানা সাদকে কূটনৈতিক ভিসা প্রদান করে। কিন্তু প্রধান কয়েকজন নেতা বিষয়টি নিয়ে যে নোংরা রাজনীতি করেছেন, তাবলিগের ইতিহাসে তা এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের সূচনা করেছে। কাকরাইলের সব শূরাদের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে মাওলানা সাদকে ফিরিয়ে দিতে সরকারকে বাধ্য করা হয়েছে।
মাওলানা সাদ শরিয়ত ও রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে এমন কী অপরাধ করেছেন, যার কারণে তাকে গত বছর ফিরিয়ে দিতে হল? কোন তার বিভিন্ন বয়ানকে কাটপিচ করে অপপ্রচার করা হচ্ছে। কাদের স্বার্থে?
এ দেশে অনেক মুসলিম নিধনকারী ঘৃণিত ব্যক্তির আগমন ঘটে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন হয় না, আন্দোলন হয়েছে মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর একমাত্র জীবিত উত্তরাধিকারীকে ফিরিয়ে দিতে। ভারতে বড় বড় ইজতেমা হচ্ছে কই! দেওবন্দ বা ভারতের আলেমরা তো তাকে কোন ইজতেমায় বাঁধা দিচ্ছে না।
বাংলাদেশে কি গতবছর নতুন কোনো মাওলানা সাদ এসেছেন? ওই মাওলানা সাদই এসেছেন, যিনি ১৯৮৯ থেকে বিশ্ব ইজতেমায় বয়ান করেন। ওই ব্যক্তিই এসেছেন যিনি বিগত বিশ বছর ধরে ইজতেমার মূল বয়ান ও হেদায়াতি কথা বলেছেন।
মাওলানা সাদ কি মানুষকে দলে দলে গোমরাহ বানিয়ে ফেলছেন? যদি এমনই হয়, তা হলে ভারতের ইজতেমাগুলোতে কেন দেওবন্দ তাকে নিষেধ করে না? মাওলানা সাদের আগমনকে কেন্দ্র করে যে বাজে পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে, দেওবন্দের মুহতামিম মাওলানা আবুল কাসেম নোমানীও এর নিন্দা করেছেন।
বিশ্বে বাংলাদেশ ও তাবলিগ জামাতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে অপরিনামদর্শী এ কাজে। এতকিছুর পরও টঙ্গীর ময়দানে লাখো মানুষ চোখের পানি ঝরিয়েছে। খোদার কাছে সবার মিনতি ছিল ইয়া আল্লাহ, তুমি কল্যাণের ফায়সালা কর। ইয়া আল্লাহ, তুমি সবাইকে এক ও নেক হওয়ার তাওফিক দান কর।